আমার মানিক আর নেই

কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই ঢাকার গ্রিন রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তরুণ আলোকচিত্রী তাহির জামান প্রিয়। অকালে প্রাণ হারানো সন্তানকে নিয়ে কথা বলেছেন তাঁর মা সামসি আরা জামান

বাবা তাহির জামানের কোলে মেয়ে সাবিরা জামান

প্রিয়র সঙ্গে আমার শেষবার কথা হয় ওর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে, ১৯ জুলাই, শুক্রবার দুপুরে। রংপুর তখন ক্ষোভে উত্তাল। আবু সাঈদের অন্যায় মৃত্যুর পর ফুঁসে উঠেছে সবাই। আর এদিকে আমার উৎকণ্ঠা কাটে না। তাই জুমার নামাজের পর মুঠোফোনে প্রিয়কে কল দিলাম। দু-একটি কথা শেষে বললাম, ‘সাবধানে থেকো, বাবা।’ জবাবে উল্টো আমাকেই সে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিল, ‘তুমিও সাবধানে থাকিয়ো, মা।’

এটাই শেষবারের মতো তার কাছ থেকে আমার মা ডাক শোনা।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কাছে টাকাপয়সা কিছু আছে?’

বলল, ‘না, মা।’

ফোন রেখে ওকে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। ওর মামাকে বললাম, ‘কিছু টাকা বিকাশ করে দাও।’

চাকরি ছিল না বলে প্রিয়র টাকাপয়সার টানাটানি ছিল। দেড় মাস আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছেড়েছিল প্রিয়। আরেক প্রতিষ্ঠানে চাকরির কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম না। ও নাকি চাকরি পেয়ে আমাকে চমকে দিতে চেয়েছিল।

চমকে সে আমাকে দিয়েছে। কিন্তু আমার ছেলে এভাবে নিথর হয়ে গিয়ে যে চমকে দেবে, তা তো আমি চাইনি।

রংপুরের জুম্মাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে আমাদের বাড়ি। শুক্রবার সারা দেশ যখন উত্তপ্ত, আমাদের বাড়ি লাগোয়া স্কুলের মাঠেও ছেলেমেয়েরা নেমে এসেছিল। বিকেলে এক বোনকে সঙ্গে নিয়ে ওদের পানি খাওয়াতে গিয়েছিলাম। তখন পাঁচটার মতো বাজে। হঠাৎ দেখলাম, মুঠোফোন হাতে প্রিয়র মামা দৌড়ে আসছে। এসে আমাকে নিয়ে গেল। এর মধ্যে দেখি একের পর এক ফোন বাজছে। ফোনে একজন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি প্রিয়র বন্ধু…মা…তুমি আমাদের মা।’ আসলে তখনো বুঝতে পারিনি, আমার মানিক আর নেই।

১৯৯৭ সালের ৭ মার্চ প্রিয়র জন্ম—তাহির জামান প্রিয়। ওর মাধ্যমেই আমি প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলাম। রংপুরে আমার সূচিশৈলী হ্যান্ডিক্রাফট নামের ছোট একটি প্রতিষ্ঠান আছে। ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ কয়েকবার জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছি। এসব করে অনেক কষ্টে প্রিয়কে বড় করেছি। আমার সাধ ছিল অনেক, তবে সাধ্য ছিল না। তাই কিশোরবেলায় হাতখরচ হিসেবে কখনো ৫০ টাকা দিলে আমার ছেলে বলত, ‘মা, এত টাকা দিচ্ছ কেন! ১০ টাকা দাও, বেশি টাকা দিলে আমি নষ্ট হয়ে যেতে পারি।’

বই পড়তে ভালোবাসত ও। তাই ছোটবেলায় ওকে বই কিনে দিতাম। কিছুদিন আগে বলেছিল, ‘মা, তুমি আমাকে বই পড়তে শিখিয়েছিলে বলেই আজ আমি ছবি তুলি, ছবি বানানোর চেষ্টা করি ও স্বপ্ন দেখি।’

যখন সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত, তখনই প্রথম একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়েছিল। মনে আছে, আমাদের রংপুর টাউনহলে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। তখন ছেলেকে নিয়ে আমার কী গর্ব!

কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন চলাকালে গ্রিন রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তরুণ আলোকচিত্রী তাহির জামান

সে সময় থেকেই প্রিয়র মাথায় ঢুকে গেল ছবির পোকা। আমাকে বলত, ‘বড় হয়ে আমি ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়ব।’

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ও ঢাকায় চলে গেল। আলোকচিত্র বিষয়ে পড়ালেখার জন্য পাঠশালা (সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট)-এ ভর্তি হলো। তার এই পড়াশোনা নিয়েও আমাকে কম কথা শুনতে হয়নি। ওর দাদাবাড়ির লোকজন বলত, ‘ছবি তুলে জীবনে করবে কী! ছেলেটাকে লাই দিয়ে দিয়ে তুমি নষ্ট করেছ।’

আমার ছেলে ঠিকই মানুষের মতো ‘মানুষ’ হয়েছিল। কারও বিপদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। প্রতিবছর কোনো না কোনো দলের সঙ্গে শীতবস্ত্র বিতরণ করত। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও নাকি এক বন্ধুর মাথা ফেটে গেছে বলে ডাক্তার দেখিয়ে তাকে বাসায় রেখে এসেছিল। ২০১৩ সালে রংপুর গণজাগরণ মঞ্চের সে ছিল সংগঠকদের একজন। শুনেছি, ঢাকার গ্রিন রোডে যখন সে তিন বন্ধুসহ দাঁড়িয়ে ছিল, তখন সে গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তার লাশ যখন পাওয়া যায়, তখন ওর এক পায়ে লেখা ছিল ৫২ নম্বর সিরিয়াল, আরেক পায়ে লেখা ছিল ‘অজ্ঞাতনামা’। কেন এমন হলো?

প্রিয়র চার বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। নাম সাবিরা জামান। বাবাকে সে ‘প্রিয়বাবা’ বলে ডাকে। ঢাকা থেকে রোববার আমার ছেলেটা যখন রংপুরে লাশ হয়ে ফিরে এল, তখন বাবাকে নিথর পড়ে থাকতে দেখে সাবিরা ভেবেছে, ওর বাবা ঘুমিয়ে আছে। সবাইকে সে বলছিল, ‘আমার বাবা ঘুমিয়ে আছে…আই লাভ ইউ বাবা…আই মিস ইউ বাবা।’

সাবিরার এমন কথায় আশপাশের কেউই সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু আমার চোখে অশ্রু কই? আমি যে কাঁদতেও ভুলে গেছি। আমার যে ছেলে ফোন করলেই বলত, ‘মা, আমার জন্য টেনশন করিয়ো না, আমি ভালো আছি’, আমার সেই প্রিয় এখন কই? আকাশ থেকে সে কি তার মাকে, মেয়েকে দেখতে পাচ্ছে?

(অনুলিখিত)