ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে পড়ে কী পেলাম

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের একাংশ
ছবি: সংগৃহীত

অকপটেই বলি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়ার পরিকল্পনা আমার কখনোই ছিল না। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রবল ইচ্ছে থেকেই এই ‘অপ্রচলিত’ বিষয়ে সুযোগ পেয়েও ভর্তি হয়ে যাই।

 আমি হতাশায় ডুবে যেতে চাইনি। তাই প্রথম থেকেই নিজের বিভাগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করেছি। ভাগ্যিস, ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ পারিবারিক সূত্রেই পাওয়া ছিল। তাই মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। বরং নতুন ভাষা শেখা, নতুন কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে ২০১৬ সালে শুরু হয়েছিল এক রোমাঞ্চকর যাত্রা।

ফারসির দুনিয়া

ফারসি ভাষার বর্ণপরিচয়, টুকটাক শব্দ-বাক্য শিখে প্রথম বর্ষ পার হওয়া গেল ঠিকই। দ্বিতীয় বর্ষে বিস্তারিত সাহিত্য পড়তে গিয়ে সত্যি বলতে একটু বিপাকেই পড়লাম। তবে ধীরে ধীরে ভাষাটা যখন রপ্ত হয়ে গেল, ফারসি সাহিত্যের মিষ্টি স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করলাম। হাফিজ, জালাল উদ্দিন রুমি, শেখ সাদী, ফেরদৌসী, জামি, ফরিদ উদ্দিন আত্তারসহ আরও বহু জ্ঞানীগুণী জনের সাহিত্যকর্মের ব্যাপারে জানলাম।

পড়তে গিয়ে প্রাচীন বা আধুনিক সাহিত্য ছাড়াও ইরানি ইতিহাস-ঐতিহ্য, নাটক-সিনেমা, পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে বিস্তারিত জানার সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ইরানি বিভিন্ন লোকজ উৎসব, বিশেষত নওরোজ বা ‘ইরানি নববর্ষ ' পালন বিভাগের সহশিক্ষা কার্যক্রমে থাকায় এতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলাম।' ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র' থেকে সনদ ও পুরস্কারও পেয়েছি।

বিভাগীয় ক্লাসগুলোর বাইরেও ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে। কারণ ফারসি সাহিত্যের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে তখন উদ্‌গ্রীব ছিলাম। একেকটা ক্লাস শেষে জীবনভাবনা নতুনভাবে হাজির হতো আমার সামনে। টিএসসি পার হয়ে বিকেল বেলা হাঁটতে হাঁটতে কার্জন হল পেরিয়ে যখন আমার হলে আসতাম, মাথার মধ্যে রহস্যময় কবিতাগুলো ঘুরপাক খেত।

দেশে আছে নানা সুযোগ

 ১২০৪-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ফারসি এ উপমহাদেশের দাপ্তরিক ভাষা ছিল। তাই বহু ফারসি শব্দ, বাক্য, প্রবাদ-প্রবচন, গল্প, রূপকথাগুলো কখনো সরাসরি আবার কখনো অনূদিত হয়ে বাংলা সাহিত্যেও প্রবেশ করেছে। সে সূত্র ধরেই দেশের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার ও গবেষণার একটি বড় ক্ষেত্র আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। যা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি কোর্স হিসেবেও সংযুক্ত আছে। যেন কেউ চাইলে এ নিয়ে গবেষণা করতে পারে।

'ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র' প্রতি বছর বিভিন্ন জার্নাল-ম্যাগাজিন বের করে। বিভাগীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বা গবেষণামূলক লেখা, অনুবাদ স্থান পায় এই সাময়িকীতে। পারস্যের মূল্যবান সাহিত্য গুলো অনেক আগে থেকেই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছে অনুবাদ চর্চার মাধ্যমে। আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণের সাহিত্য, এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসকে ইরানিদের কাছে সহজলভ্য করতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বইগুলোও ফারসি ভাষায় অনুবাদের কাজ চলছে। এ ছাড়া ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে স্নাতকোত্তর বা পিএইচডির জন্য ইরান সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বৃত্তিও দেওয়া হয়।

ইরান-বাংলার সংস্কৃতি বিনিময়ে বিভিন্ন লোকজ-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দুই দেশের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁদের কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা এবং সেমিনারের আয়োজন হয় আমাদের বিভাগে। দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় আরও জোরালো করতে ইরান-বাংলাদেশ যৌথ সিনেমা এবং বিভিন্ন ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হচ্ছে, যেখানে বিভাগীয় শিক্ষার্থীরা অনুবাদক ও দোভাষী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।

কী পেলাম

এই বিভাগ থেকে ভালো সিজিপিএ নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পেরিয়ে মনে হয়, আমি শুধু ডিগ্রিই অর্জন করিনি; বরং আমার পরবর্তী জীবনের পথচলার পাথেয় পেয়েছি। এই সমাজে বস্তুগত সাফল্যকে বেশ বড় করে দেখা হয়। কিন্তু তা পাওয়ার জন্য আত্মা ও মনের যে শক্তি দরকার, তা আমি পেয়েছি সাহিত্যে রস থেকে। এই বিভাগে পড়ব কি পড়ব না, ভবিষ্যতে কী হবে, চাকরি পাব কি পাব না, এমন নানা দ্বিধায় সব সময় ভরসা দিয়েছেন আমার বাবা। বাবা বলেছিলেন, ‘এমনটা জরুরি নয় যে এখন যা পড়ছ সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই কাজে দেবে। বরং জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কাজে লাগবে অবশ্যই।’ সেই বিশ্বাস রেখেই নতুন নতুন সম্ভাবনা খোঁজ করে এগিয়ে চলছি। আর এই চলার পথে রুমির মসনবী, উমর খৈয়ামের রুবাই, সাদি আর হাফিজের গজল আমার সঙ্গেই আছে।