মেরুদণ্ড জোড়া লাগা অবস্থাতেই পৃথিবীতে আসে নাফিসা আলিয়া নূহা ও নাফিয়া আলিয়া নাবা। শরীরের পেছন ও নিচের দিকের অংশ যুক্ত এই দুই বোনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করেছেন বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। ২৫ নভেম্বর মা-বাবার সঙ্গে বাড়ি ফেরার আগে প্রায় ৩২ মাস তাদের তত্ত্বাবধান করেন বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগের স্পাইনাল নিউরোসার্জারি শাখার প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন। তাঁর কাছে এই দীর্ঘ যাত্রার গল্প শুনে লিখলেন রাফিয়া আলম
২০২২ সালে একটা বৈজ্ঞানিক সভায় যোগ দিতে কুড়িগ্রামে গিয়েছিলাম। সভায় সেখানকার চিকিৎসকদের কাছে কুড়িগ্রামে সদ্য জন্ম নেওয়া জোড়া লাগা যমজ শিশুদের ব্যাপারে জানতে পারি। শিশু দুটিকে আলাদা করার কাজে আমাকে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানালেন তাঁরা। রাত হয়ে যাওয়ায় সেদিন আর শিশু দুটিকে দেখতে যাওয়া হয়নি।
পরদিন স্থানীয় ক্লিনিকে তাদের দেখতে গেলাম। জন্মগতভাবেই তাদের শরীরের পেছন এবং নিচের অংশ জোড়া লাগা। জেলা শহরের সেই ক্লিনিকে উন্নত চিকিৎসার তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেই। সেখানকার চিকিৎসকেরা যে এভাবে জোড়া লাগানো শিশু দুটিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুস্থ অবস্থায় পৃথিবীতে নিয়ে আসতে পেরেছেন, সেটিই অবিশ্বাস্য। যখন শিশু দুটিকে প্রথম দেখি, তারা কাঁদছিল। কাঁদছিলেন তাদের মা-বাবাও। শিশুদের বাবা একজন পরিবহনশ্রমিক। মা গৃহিণী। উন্নত চিকিৎসার আর্থিক সামর্থ্য তাঁদের নেই। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না এই সন্তানদের নিয়ে তাঁরা কী করবেন? কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ? আমি তাঁদের বিএসএমএমইউতে নিয়ে আসতে বললাম।
যদিও এ ধরনের অস্ত্রোপচারের অভিজ্ঞতা ছিল না এবং আদতেই দেশে তা করা সম্ভব কি না, তা–ও তখন জানতাম না। তবু একজন স্পাইনাল নিউরোসার্জন হিসেবে তাঁদের সাহায্য করাটাকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে হলো। ওদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার একটা তাড়নাও বোধ করলাম। সংকল্প করলাম, যেখানেই হোক, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকায় ফিরে এলাম।
শিশু দুটির মা-বাবাও দেরি করেননি। তাঁরা শিশু দুটিকে এনে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করালেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমি বিষয়টি জানালাম।
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেল, শিশু দুটির মেরুদণ্ডের হাড় এবং স্পাইনাল কর্ড দুটোই জোড়া রয়েছে। এ ধরনের জোড়া যমজ শিশুদের বলা হয় ‘কনজয়েন্ট টুইন পিগোপেগাস’। এই শিশুদের অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। স্পাইনাল কর্ড এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা দেহের বিভিন্ন পেশির সঞ্চালন এবং বিভিন্ন শারীরিক অনুভূতি মস্তিষ্কে পাঠানোর মতো জরুরি কাজ করে। শিশু দুটিকে আলাদা করতে গিয়ে যদি কোনো একজনের স্পাইনাল কর্ডে সামান্যতম আঘাতও লেগে যায়, তাহলে সেই শিশুটি পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে তার শারীরিক অনুভূতি। নষ্ট হয়ে যেতে পারে তার প্রস্রাব-পায়খানা নিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক ক্ষমতা। মোটকথা, তার ও তার পরিবারের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ার বিশাল ঝুঁকি মাথায় রেখেই অস্ত্রোপচার করতে হবে। স্পাইনাল কর্ড ঠিক কোন জায়গাটি থেকে আলাদা করলে দুজনের কারোরই এ ধরনের ক্ষতির ঝুঁকি থাকবে না, তা নির্ধারণ করাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুজনের হৃৎপিণ্ডেই আবার জন্মগত ছিদ্রও আছে।
পেশাগত সূত্রে চেনা বিভিন্ন দেশের স্পাইনাল নিউরোসার্জনদের সঙ্গে শিশু দুটির ব্যাপারে আলাপ করলাম। একসময় আত্মবিশ্বাস জন্মে গেল, দেশেই সম্ভব। সব ধরনের ঝুঁকি মাথায় রেখেই শুরু হলো প্রস্তুতি। শিশু দুটি একটু বড় হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হলো। এরপর বেশ কয়েকটি ছোট ছোট অস্ত্রোপচার সেরে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মূল অস্ত্রোপচারটি করা হয়। এই অস্ত্রোপচারে অংশ নিয়েছেন প্রায় ১০০ চিকিৎসক, যাঁদের ৩৯ জনই বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। আমি ছিলাম এই দলের প্রধান। মোট আটটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসক দল কাজ করেছে এই শিশুদের জন্য।
জন্মগতভাবে শিশু দুটির পায়ুপথও জোড়া। দুজনের মলত্যাগের জন্য পৃথক পথ তৈরি করে দেওয়াটাও বিশেষ ধরনের একটি প্রক্রিয়া। দুজনের রক্তনালিগুলো নিরাপদে আলাদা করার জন্যও বিশেষজ্ঞ দল কাজ করেছেন। মেরুদণ্ড ও স্পাইনাল কর্ড আলাদা করা, সাময়িকভাবে মলত্যাগের জন্য পেটের এক পাশে পৃথক পথ (কোলোস্টমি) করে দেওয়াসহ সম্পূর্ণ অস্ত্রোপচারে সেদিন সময় লেগেছিল ১৫ ঘণ্টা।
এত বড় অস্ত্রোপচারের পর স্বাভাবিকভাবেই শিশু দুটিকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখতে হয়েছে। পুরো সময়টা তাদের মা-বাবাকে সাহস দিয়েছিলাম আমরা। আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে থাকা শিশু দুটি যখন স্বাভাবিকভাবে হাত-পা নাড়াতে শুরু করেছিল, সেই সময়টা ছিল চিকিৎসক হিসেবে আমাদের জন্য ভীষণ আনন্দের; চিকিৎসকের পেশাদারত্ব ছাপিয়ে মানুষ হিসেবে অন্য রকম এক ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করছিল নিজের ভেতর। সে যেন এক স্বপ্নপূরণের অনুভব। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের দিনগুলো পেরিয়ে কেবিনে এল শিশু দুটি। ধীরে ধীরে হাঁটতেও শিখল। নিজেদের মাঝে খুনসুটিও চলেছে তাদের বেশ!
এ ধরনের অস্ত্রোপচার দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার জন্য একটি মাইলফলক। ভবিষ্যতে চিকিৎসকেরা এমন সাফল্যে অনুপ্রাণিত হবেন। তবে এই সাফল্য কারও একার নয়। অস্ত্রোপচার ও শিশু দুটির চিকিৎসার বিভিন্ন ধাপে অংশগ্রহণকারী নিউরোসার্জন, শিশু সার্জন, প্লাস্টিক সার্জন, ভাসকুলার সার্জন, ইউরোলজিস্ট, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞসহ সব চিকিৎসক এবং বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে এই জটিল প্রক্রিয়া। চিকিৎসক, নার্সসহ হাসপাতালের সব কর্মীরই অবদান রয়েছে পুরো চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায়। শিশু দুটির অস্ত্রোপচারের একটি ধাপ এখনো বাকি রয়েছে। তাদের পরবর্তী যেকোনো চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছেন বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।
শিশু দুটি যেদিন বিএসএমএমইউতে ভর্তি হয়, তাদের বয়স ছিল ১৪ দিন। ২ বছর ৭ মাস ২২ দিন বয়সে হাসতে হাসতে নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেল তারা। এখন তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে। এ ধরনের শিশুদের অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ছোটখাটো জটিলতা হতে পারে। তবে বড় ধরনের জটিলতার আশঙ্কা নেই। চিকিৎসক হিসেবে জীবনের দীর্ঘপথে যত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে, যত রোগী দেখেছি, যত অস্ত্রোপচার করেছি, সবকিছুর মাঝে সব সময়ই আলাদাভাবে মনে থাকবে হাসিখুশি, নিষ্পাপ এই শিশু দুটির মুখ। অন্তর থেকে তাদের জন্য শুভকামনা থাকবে নিরন্তর।
সুন্দর এই পৃথিবীতে অন্য শিশুদের মতোই শিশু দুটি বড় হয়ে উঠুক।