বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? এই ৫ ভুল করছেন না তো

উচ্চশিক্ষার জন্য ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার পথটা সহজ নয়। ‘শর্টকাট’ খুঁজতে গিয়ে অনেকেই দিশাহারা হয়ে পড়েন। প্রচলিত পাঁচটি ভুল ধারণা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

‘শর্টকাট’ খুঁজতে গিয়ে অনেকেই দিশাহারা হয়ে পড়েন
ছবি: পেক্সেলস

‘আইইএলটিএস, টোয়েফলের প্রয়োজন নেই’

আইইএলটিএস-টোয়েফলের স্কোর ছাড়া, কিংবা স্কোর কিছুটা কম নিয়েও যে নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায়—এ কথা একেবারে মিথ্যা নয়। কিন্তু আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পড়তে যেতে চান, আইইএলটিএস বা টোয়েফল ছাড়া যাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইংরেজি ভাষার দক্ষতা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ, তারা চায়, শিক্ষার্থী যথাযথভাবে ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা, গবেষণা, এবং বিভিন্ন একাডেমিক কাজ করতে সক্ষম হোক। ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ার কলেজ অব ফার্মাসির ডক্টরাল শিক্ষার্থী অতনু চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘অনেকে ফেসবুক বা অনলাইনে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে বিভ্রান্ত হন। আইইএলটিএস বা টোয়েফল পরীক্ষার স্কোর শুধু ভর্তির জন্য নয়, ভিসা প্রক্রিয়ায়ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ দেশের দূতাবাস ও ভিসা কর্তৃপক্ষ এসব পরীক্ষার স্কোরের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর আবেদন মূল্যায়ন করে। তাই আইইএলটিএস বা টোয়েফল স্কোর ছাড়া বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগের চিন্তা করাটা বাস্তবসম্মত নয়। যেসব প্রতিষ্ঠান এসব স্কোর ছাড়াই বিদেশ আসার ডাক দেয়, তাদের এড়িয়ে চলা ভালো।’

‘শর্টকাটে’ বিদেশ যাওয়া যায়

অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে কাগজপত্র তৈরি করে, নকল সনদ জমা দিয়ে ভিসার লাইনে দাঁড়ালেই বিদেশ পড়তে যাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ ভাবেন, ‘আমার কিছুই করা লাগবে না। কাগজপত্র যা লাগে, সব এজেন্সিই করে দেবে।’ এভাবে ভর্তি সম্ভব নয়। বিদেশে পড়তে যাওয়ার কোনো ‘শর্টকাট’ নেই। ‘শর্টকাট’ পথে গেলে পরে বিপদে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার‌্যাক্টিভ মিডিয়া ও প্রোডাক্ট ডিজাইন বিভাগের শিক্ষার্থী মহিদুল আলম বলেন, ‘বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সময় ও অর্থ দুটোই নষ্ট হবে। সঠিক তথ্য যাচাই করুন, পেশাদার পরামর্শ নিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতে হয় অনেক আগে থেকে। “১০ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে পড়তে যান”—এমন চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। যেমন আইইএলটিএস বা টোয়েফল, জিআরই পরীক্ষার জন্য সময়মতো প্রস্তুতি নেওয়া। সব সময় যে এজেন্সির শরণাপন্ন হতে হবে, তা-ও নয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন অফিস সাধারণত সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকে। সরাসরি তাঁদের কাছে ই–মেইল করেই আপনি অনেক তথ্য জেনে নিতে পারবেন। অনেকে হয়তো বিমানে চড়ে ভিনদেশে চলেও যান, কিন্তু গিয়ে দেখেন ভিন্ন বাস্তবতা। থাকার জায়গার ঠিক নাই, কাজ নাই—এমন অনেক কঠিন বাস্তবতা সামনে আসে। অন্তত প্রথম কয়েক মাস চলার জন্যও কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়। ঠিকঠাক প্রস্তুতি না নিয়ে বিপদে পড়বেন না।’

‘এক দেশে ভর্তি হয়ে পরে অন্য দেশে চলে যাব’

এই ধারণাও আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে। বেশির ভাগ বৃত্তি ও ভিসার শর্ত অনুযায়ী, পড়াশোনা শেষ করে অবশ্যই দেশে ফিরতে হয়। নাগরিকত্ব নেওয়া বা অন্য দেশে স্থানান্তরের সুযোগ সীমিত। খুব কম ক্ষেত্রেই কোর্স বা ক্রেডিট স্থানান্তরের সুযোগ থাকে। কথা হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের পিএইচডি শিক্ষার্থী রৌনক সাহার সঙ্গে। বললেন, একেক দেশে একেক ধরনের নিয়ম। অনেকেই মনে করেন বিদেশে পড়াশোনা করলেই সুযোগ অনেক বেশি, জীবন বদলে ফেলা যাবে। আদতে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অনেক চ্যালেঞ্জিং। অনেকেই ইউরোপের অনেক অপরিচিত দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তাঁদের লক্ষ্য থাকে আপাতত একটা ছোট দেশে গিয়ে পরে অন্য দেশে চলে যাবেন। এমনটা মাথায় না আনাই ভালো। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক তথ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে পাবেন। এসব পড়ে বুঝে-শুনে আসুন। হুজুগে আসা যাবে না। অনেকে সাইপ্রাসসহ বেশ কিছু দেশের ভর্তির অফার লেটার নিয়ে বিদেশে আসেন। এসব করে টাকা হারানো থেকে শুরু করে নানাভাবে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

‘বৃত্তির অর্থ দিয়েই সব খরচ চালানো যায়’

বৃত্তি পাওয়া মানেই আর কোনো টাকা লাগবে না—বিদেশে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এমন ধারণাও সঠিক নয়। অধিকাংশ বৃত্তি থেকে শুধু টিউশন ফির খরচটাই মেলে। থাকার খরচ, যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে বহন করতে হয়। রৌনক যেমন বলছিলেন, ‘বৃত্তির টাকার বাইরে আপনার টাকার প্রয়োজন হবে। গবেষণামূলক কোর্সের ক্ষেত্রে অনেক বৃত্তি সহায়ক হলেও পার্টটাইম কাজ ছাড়া সব খরচ মেটানো কঠিন। আবার পার্টটাইম কাজ করার সুযোগ অনেক সময় কম থাকে। যে দেশে পড়তে যাচ্ছেন, আগে সেই দেশের নিয়মকানুন ভালো করে জানুন। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন ক্যাম্পাসের বাইরে কাজ করার সুযোগ কম থাকে, আবার অস্ট্রেলিয়াতে সুযোগ কিছুটা হলেও আছে। অনেকে মনে করেন ইংরেজি জানলে চাকরি পেতে কষ্ট হয় না। ইউরোপের অনেক দেশে এই সুযোগ অনেক কম। জার্মানি বা নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে পড়ার পাশাপাশি চাকরি করার ক্ষেত্রে আপনাকে স্থানীয় ভাষা জানতে হবে। স্থানীয় ভাষা না জানলে চাকরি-বাকরি বা পার্টটাইম কাজের সুযোগ খুবই কম। কোনো মতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অফার লেটার নিয়ে বিদেশে পড়তে আসার পরে আপনি সংকটে পড়তে পারেন। সব খোঁজ খবর নিয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য পরিকল্পনা করা উচিত।’

‘বিদেশে পড়লেই নাগরিকত্ব, চাকরি’

বিদেশে পড়াশোনা করলেই নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে—এটি একটি বড় ভুল ধারণা। বেশির ভাগ দেশের নাগরিকত্ব নীতিমালা ভিন্ন এবং কঠোর। সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জি এম মাজিদুল ইসলাম বলেন, ‘একেক দেশের আবহাওয়া, সংস্কৃতির মতো নিয়মও আলাদা। অনেকেই মনে করেন পড়াশোনা করতে এলেই নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। কিন্তু এ জন্য আলাদা যোগ্যতা থাকতে হয়, পূরণ করতে হয় নানা শর্ত। চাকরির ক্ষেত্রেও তা–ই। যদি খণ্ডকালীন কাজ করেন, তবু আপনাকে অনেক নিয়মকানুনের মধ্যে থাকতে হবে। আইন ভাঙলে জরিমানাসহ নানা ঝামেলায় পড়তে পারেন।’ যুক্তরাজ্যের কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে পড়া শেষ করেছে আনিকা তাবাসসুম। তিনি বলেন, ‘বিদেশে কাজের পরিবেশ অনেক চ্যালেঞ্জিং। আরেকটা বড় বিষয় হচ্ছে আবহাওয়া। বাংলাদেশের মতো আবহাওয়া ইউরোপ বা আমেরিকায় পাবেন না, এটাই স্বাভাবিক। অনেকেই প্রস্তুতি না নিয়ে আসার কারণে অসুস্থতাসহ নানা ধরনের জটিলতায় পড়েন। এসব বিষয় প্রথম থেকেই মাথায় রাখতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী তাঁর পরিবার নিয়ে কিংবা বিয়ে করে বিদেশে পড়তে আসার পরিকল্পনা করছেন। স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে বিদেশে আসার জন্যও পরিকল্পনা করুন বুঝেশুনে।’

Photo by Kaboompics from pexels