কাওসার আহমেদ চৌধুরী (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৪—২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২)
কাওসার আহমেদ চৌধুরী (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৪—২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে বললাম, ‘আজ আপনার কাছে হেলিকপ্টারে করে এসেছি’

২০২২ সালের এই দিনেই প্রয়াত হয়েছেন গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরী। প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’র জনপ্রিয় এক বিভাগ ছিল তাঁর ‘আপনার রাশি’। দীর্ঘ তিন বছর রাশিফল শ্রুতিলিখনের কাজে প্রতি বুধবার তাঁর বাসায় গেছেন শাওন খান

সবে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। কম্পিউটারবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে প্রযুক্তি দুনিয়ার খোঁজখবর রাখি। সেই সূত্র ধরেই ২০১৬ সালে প্রথম আলোর প্রযুক্তি পাতায় প্রদায়ক হিসেবে আমার লেখাজোখা শুরু।

এই কাজ করতে করতেই একদিন ফিচার বিভাগের সে সময়ের যুগ্ম সম্পাদক পল্লব মোহাইমেন বললেন, ‘শাওন, তোমাকে ধানমন্ডিতে যেতে হবে। একজন মুখে বলবেন, তুমি শুনে শুনে লিখে আনবে।’

মুঠোফোনে নাম-ঠিকানা পাঠিয়ে দিলেন পল্লব ভাই, ‘কাওসার আহমেদ চৌধুরী...।’

মাথায় সবুজ টুপি, চোখে খয়েরি চশমা, রঙিন শার্ট, কালো দাড়ি—কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে অনেকের মতো পত্রিকা মারফত আমিও অতটুকুই চিনতাম। ২০১৬ সালের সেই সন্ধ্যায় মনের মধ্যে মানুষটার এই চিত্র নিয়েই তাঁর ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছালাম।

কলিবেল বাজাতেই এক কিশোর দরজা খুলল। পরিচয় দিলাম। ভেতরে গিয়ে বসতে বলল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শোবার ঘর থেকে ডাক এল। একটু ভয় ভয় মন নিয়ে ভেতরে গেলাম। পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পড়ে শুয়ে আছেন বয়স্ক এক মানুষ। খুবই গম্ভীর। আমাকে দেখে মিষ্টি বাংলায় বললেন, ‘এসেছ, বসো। আমি কাওসার আহমেদ চৌধুরী, তোমার নাম কী?’

প্রাথমিক পরিচয়ের পর সাদা কাগজ আর কলম নিয়ে লেখা শুরু করলাম, ‘রাশিফল, শনিবার। মেষ…।’ কাওসার আহমেদ চৌধুরী বলে গেলেন, আমি লিখে গেলাম। লেখা শেষে তিনি হাতে নিলেন কাগজটা, অনেক ভুল ছিল আমার লেখায়। শুধরে দিলেন।

দরজা যে খুলে দিয়েছিল, তার নাম আল আমিন। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সেবক। তার সঙ্গেও কথা হলো।

সেই শুরু। পরের তিনটি বছর প্রতি বুধবার কাওসার আহমেদ চৌধুরীর শ্রুতিলেখক হিসেবে কাজ করেছি। কাওসার আহমেদ চৌধুরী তাঁর লেখা প্রতিটি শব্দ নিয়ে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন। আর একদম তাঁর সময়মতো হাজির হওয়াটা অনেকের জন্যই চ্যালেঞ্জিং। এসব কারণে অনেকেই তাঁর শ্রুতিলেখকের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারেননি। তবে তাঁর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের কারণে দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য পেয়েছিলাম।

এমন প্রায়ই হয়েছে, আমি ছয়টার আগে পৌঁছে গেছি। তখন বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ঘড়িতে যেই ছয়টা বাজত, অমনি কলবেল চাপতাম। এ জন্য তিনি সব সময় বলতেন, ‘শাওন তোমার সময়জ্ঞান খুবই ভালো।’

সারা সপ্তাহ যা–ই করি না কেন, আমার বুধবার দিনটি থাকত তাঁর জন্য বরাদ্দ। কতটা বরাদ্দ, এ বিষয়ে একটি ঘটনা বলি।

কাওসার আহমেদ চৌধুরী এখন ছবির মানুষ

এক বুধবার আমি আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ছিলাম। সেদিন আমার দাদা-দাদু অস্ট্রেলিয়া থেকে দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা হলো। ইচ্ছা হচ্ছিল আরও কিছুটা সময় বাড়িতে থাকি। কিন্তু এদিকে সকাল থেকেই আমার চিন্তা, ঢাকায় ফিরতে হবে, কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কাছে যেতে হবে, রাশিফল লিখতে হবে। তখন মাথায় এক বুদ্ধি চাপল, ঢাকা থেকে দাদা-দাদু কুলিয়ারচরে যে হেলিকপ্টারে পৌঁছাবেন, সেটাতে করেই আমি ফিরব। হলোও তা-ই। হাজার বিশেক টাকা বেশি দিয়ে আরও কয়েকজন কাজিনসহ আমি সেই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় ফিরলাম। সেখান থেকে সোজা কাওসার আহমেদ চৌধুরীর বাসায়। তাঁকে গিয়ে বললাম, ‘আজ আপনার কাছে এসেছি হেলিকপ্টারে করে।’

তিনি মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আমি জানতাম, আজ তুমি অসাধারণ কিছু করবে।’

শহীদ মিনারে যেতে চাই

২০১৯ সালের শেষে কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে আমাকে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর শ্রুতিলেখকের কাজটিতে ইস্তফা দিতে হয়। তিনি আমাকে কতটা স্নেহ করতেন, তাঁর অনেক স্মৃতি। সেরা একটির কথা বলি। ভাষা আন্দোলনের সময় কাওসার আহমেদ চৌধুরী ছোট ছিলেন। এক ভাষার মাসে একুশে ফেব্রুয়ারির আগে তিনি আমাকে সেই গল্প বলছিলেন। তাঁকে বললাম, ‘আসছে একুশে ফেব্রুয়ারিতে আপনার সঙ্গে শহীদ মিনারে যেতে চাই।’

তিনি রাজি হলেন।

একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পথে গাড়িতে, ২০১৯

তখন তিনি শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ। একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে তিনি, আল আমিন আর আমি গাড়িতে করে রওনা দিলাম। গাড়ি নিয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যাওয়া গেল না। কাছাকাছি পৌঁছে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। কাওসার আহমেদ চৌধুরী আমার কাঁধে ভর করে হেঁটেছেন বেশ কিছু দূর। এর মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর হাঁটা হলো না। দূর থেকেই শহীদ মিনার দেখলেন। অনেক গল্প বললেন। তারপর বললেন, ‘চলো, ফুচকা খাই।’

ফুচকা খেয়ে তাঁকে বাসায় রেখে এলাম।

শেষ মেসেজ

কাওসার আহমেদ চৌধুরী একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘শাওন তুমি অস্ট্রেলিয়ায় যাবে, তবে দেরি হবে।’ এখন আমি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে লিখছি। অনেক কিছু লিখব ভেবে বসেছিলাম, কিন্তু জানি লিখে শেষ করা যাবে না। তাই আমার মুঠোফোনে আসা তাঁর শেষ বার্তাটি দিয়েই শেষ করি, ‘৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ (ইংরেজিতে) ‘কেমন আছ শাওন, অনেক দিন দেখা হয় না। তুমি সব সময় আমার মনে আছ। সব সময় আমার শুভকামনায় আছ। সময় পেলে আমাকে দেখতে আসার চেষ্টা কোরো। ব্যস্ত থাকো। সফল হও। নিজের জন্য ভালো করো। অন্যের জন্য ভালো করো। সুখে থাকো।’

আপনিও ভালো থাকবেন, প্রিয় কাওসার আহমেদ চৌধুরী।