৫ আগস্টের পরের কয়েকটা দিন পুলিশ না থাকায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে মাঝরাতে রাস্তায় নামে সাধারণ মানুষ। দিন দিন মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় এটা হয়ে ওঠে সামাজিক মিলনমেলা। পাহারাকে ঘিরে রাতে কোনো পাড়ায় বসে ক্রিকেটের আসর, কোনো পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গলির রাস্তায় মাঝরাতে চেয়ার পেতে আড্ডা চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পাশাপাশি বা একই ভবনে থেকেও এত দিন যাদের মধ্যে পরিচয় ছিল না, তাদের মধ্যে নতুন করে পরিচয় গড়ে ওঠে।
৫ আগস্ট বিকেল থেকে বলতে গেলে একরকম পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে ঢাকা। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সাধারণ মানুষের আনন্দ–উচ্ছ্বাস খানিকটা মিইয়ে পড়ে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেঁকে বসে নতুন এক আতঙ্ক—ডাকাত। কীভাবে ডাকাতি প্রতিরোধ করা যায়, ওই রাতেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন মোহাম্মদপুর এলাকার সলিমুল্লাহ রোডের কয়েক তরুণ। সেই ভাবনা থেকেই নিজেরা একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেন। এই দলের অন্যতম উদ্যোক্তা সৈয়দ রিদওয়ান হোসেন বলেন, ‘গ্রুপে শুরুতে ছিলাম আমরা তিনজন। পরদিন ফেসবুকে সেটা শেয়ার করে এলাকার লোকজনকে অ্যাড হতে উদ্বুদ্ধ করি। ডাকাত এলে কী করতে হবে, এ–বিষয়ক নানা পরামর্শও দিতে থাকি। কেন দা-বঁটি বা ধারালো অস্ত্র না নিয়ে লাঠি নিতে হবে, সেসব পোস্ট করি। দ্রুত আশপাশের লোকজন সেই গ্রুপে যোগ দিতে শুরু করে। এরপর দলে দলে ভাগ হয়ে আমরা সলিমুল্লাহ রোডের বাড়িঘর পাহারা দিতে শুরু করি। নানা বয়সের মানুষ, নারী-পুরুষ এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।’ পেশায় স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান রিদওয়ান জানান, এই রোডে ৩০টির মতো বাড়ি আছে। সব বাড়ি থেকেই লোকজন এসে গল্পগুজব করছে, আড্ডা দিচ্ছে। গ্রুপে প্রতিদিন সেনাবাহিনীর টহল দলের নম্বর আপডেট হচ্ছে। মানুষের ভয়ও কিছুটা কমেছে।
একই রকম উদ্যোগ নিয়েছিলেন মোহাম্মদপুরে শেখেরটেক এলাকার প্রমিনেন্ট হাউজিংয়ে বসবাসরত লোকজনও। এই হাউজিংয়ের বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান একটি আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই হাউজিংয়ে ৩০টি ভবনে প্রায় ৪০০ পরিবারের বাস। এত দিন হাতে গোনা কয়েকজনের সঙ্গেই পরিচয় ছিল। কিন্তু পাহারায় বেরিয়ে এখন নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। প্রতিদিন নানা রকম আয়োজন হচ্ছে। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় পালা করে দুই শিফটে রাতে পাহারা দিচ্ছি আমরা। সেই উপলক্ষে বিশাল ডেকচিতে করে খিচুড়ি, তিহারি রান্না হচ্ছে। দীর্ঘ সময় একসঙ্গে গল্পগুজবের ফলে সবার মধ্যে বন্ধন গড়ে উঠেছে।’
মিরপুর এলাকার কয়েকটি গলি ঘুরেও একই ধরনের দৃশ্য চোখে পড়ল। কাজীপাড়ার একটি গলিতে কিছুক্ষণ পরপর পাঁচ থেকে ছয়জনের একেকটি দল চোখে পড়ে। কোনো দল নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, কেউ কেউ অনলাইনে লুডু খেলছে। পাশে রাখা চ্যালা কাঠ। মোটরসাইকেল থামাতেই এগিয়ে এলেন দুজন। মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদ মানসুর জানান, রাত ১২টার পর থেকে কাজীপাড়ার বিভিন্ন গলিতে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পাড়ার ছেলেরা জেগে থাকেন। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই দ্রুত ফোনে বাকি গ্রুপগুলোকে জানানো হয়।
ডাকাতের আতঙ্কে পুরো দেশ যখন তটস্থ, ধানমন্ডি সোসাইটির পক্ষ থেকে তখন একসঙ্গে ২০ থেকে ২৫টি গাড়িতে করে টহল দিতে দেখা যায়। পাহারা দলে থাকা ধানমন্ডির স্থায়ী বাসিন্দা জিবরান ইবনে আতিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার নিজেদের গাড়ি নিয়ে এসে এলাকাবাসীর আতঙ্ক কাটাতে চেষ্টা করছি। দুই দিন পর থেকে যখন গাড়ির সংখ্যা বেড়ে ৪০ থেকে ৫০টি হয়েছে, তখন বিভিন্ন এলাকায় ১০ থেকে ১৫টি করে গাড়ি ভাগ হয়ে পাহারা শুরু হয়। এভাবে পুরো ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় পাহারা চলছে, পুলিশের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু না হওয়া পর্যন্ত চলমান থাকবে।’ ব্যক্তিগত গাড়ির দল ছাড়াও আলাদা কয়েকটি ছোট পিকআপ ভাড়া করে সিকিউরিটি টহলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একটি অ্যাপও ডেভেলপ করা হয়েছে, যেখানে যেকোনো সমস্যায় দ্রুত সাড়া মিলছে। ধানমন্ডির বাসিন্দা রুমিনা নাসরীন বলেন, ‘যেদিন থেকে দেখছি কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি করে ছেলেরা টহল দিচ্ছে, সেদিন থেকে শান্তি লাগছে। প্রথম দুই দিন তো আতঙ্কে সারা রাত জেগে ছিলাম। তাই কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকে ওদের জন্য একদিন খাবার পাঠিয়েছি।’
বনানীর স্থায়ী বাসিন্দা আপন আহসান একজন সংস্কৃতিকর্মী। তিনি জানান, বনানী সোসাইটির ব্যানারে এই এলাকার বাসিন্দারা ৬ আগস্ট থেকে প্রতি রাতে পাহারা দিচ্ছেন। আপন আহসান বলেন, ‘শুরুটা ৪ থেকে ৫ জনের উদ্যোগ হলেও সেই সংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০–এ পৌঁছাতে সময় লাগেনি। নিজ দায়িত্বেই সবাই এগিয়ে এসেছেন। যে কারণে প্রথম দিন কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও পরে সেটা সামলানো গেছে। রাতে যাঁরা পাহারায় দিতে চান, আসার আগে গ্রুপে জানিয়ে দেন। এরপর একটা ফর্ম পূরণ করেন। তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর অনুমতি মেলে। রাতে যাঁরা টহলে থাকেন, সোসাইটির উদ্যোগের বাইরেও তাঁদের জন্য বিভিন্ন বাসা থেকে নানা রকম খাবার আসে। দলমত ভুলে আমরা বনানীবাসী—এ পরিচয়ই সবার কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। টহল দলে ছেলে, মেয়ে, তরুণ, মাঝবয়সী—সব রকম লোকই আছে। রাত জেগে তাঁরা আরও নানা রকম উদ্যোগ নিয়ে ভাবছেন। ট্রাফিক সিস্টেম, নো হর্ন ক্যাম্পেইন, বৃক্ষরোপণ, দেয়ালচিত্রের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ছেলেমেয়েরা নিয়মিত কাজ করতে চায়।’
ঢাকার প্রায় সব কটি এলাকারই এখন এমন চিত্র। একজনের বিপদে অন্যরা এগিয়ে আসছেন; শহুরে জীবন থেকে যা প্রায় নাই হয়ে গিয়েছিল। একজনের বিপদে অন্যজন চুপ থাকাই যেন রীতি হয়ে উঠেছিল। নগরায়ণের ফলে মানুষ অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে কী চলছে, সেটা একান্তই যেন তাঁর ব্যক্তিগত। বাস্তবতা থেকেই হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলে সামাজিক জীব হিসেবে সবকিছু এড়িয়ে একা বাঁচা যায় না, মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এই যেমন এখন দরকারে তাঁরাই আবার একে অন্যের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোস্তফা খানম বলেন, ‘সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যূথবদ্ধতা। কমিউনিটি বোধ থেকে “আমি” নয়, “আমরা” ভাবতে শেখা জরুরি। সামাজিক জীব হিসেবে একজন অন্যের পাশে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যও তা–ই বলে। কিন্তু মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে হতে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছাল যে একটা বড় ঘটনার মাধ্যমে হলেও আবার সেই দলবদ্ধ ভাবনায় ফিরে গেল। এই যে উদ্যোগ গড়ে উঠেছে, সেটাকে টিকিয়ে রাখা জরুরি।’
এই যে এখন রাত জেগে এলাকাবাসী পাহারা দিচ্ছেন, সেটা হয়তো সাময়িক। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেই এই টহলের আর দরকার হবে না। তবে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকার যে সুবিধা, সেটা বজায় রাখতে যোগাযোগটা টিকিয়ে রাখা উচিত। কীভাবে সেটা ধরে রাখা যায়, সে বিষয়েও কিছু ভাবনা জানিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী সুলতানা মোস্তফা খানম—
পাড়ায় যেভাবে প্রতিরোধব্যবস্থা করা হয়েছে, সেভাবে একটি করে সংগঠন গড়ে তোলা যায়।
যে ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপভিত্তিক গ্রুপ তৈরি হয়েছে, সেটাকেও সচল রাখা যায়। সেখানে সবাই যুক্ত হয়ে নিজেদের কমিউনিটিকে শক্তিশালী করতে পারে।
ভবনভিত্তিক, পাড়া বা হাউজিং এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময় পরপর নানা রকম সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। এতে অন্যদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
অনেক সময় আমরা নিজের সন্তানকেই হয়তো পাড়ার সবার সঙ্গে মিশতে দিই না। কে ভালো কে খারাপ, সেসব বিচার-বিবেচনা বাইরে রেখে আগে মেশার সুযোগ দিন। একই সঙ্গে সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন থাকুন। চারপাশটা নিরাপদ হলে মা-বাবাও সন্তানকে বাইরে যেতে দেবেন। তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবারই প্রচেষ্টা দরকার।
সন্তানদের সহশিক্ষা কার্যক্রম বাড়ান।
আগে পাড়ায় ক্লাব কালচার চোখে পড়ত, যা এখন কম। এ ধরনের ক্লাবের মাধ্যমেও প্রতিবেশীদের মধ্যে একধরনের একতা গড়ে ওঠে।
নিয়মিত বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন করে পাড়ার লোকদের সেখানে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।
অসাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে তোলা।
‘কেয়ারিং অ্যান্ড শেয়ারিং’ বলে যে একটা কথা চালু আছে, বাড়িতে বাড়িতে সেটার চর্চা করতে হবে।
সর্বোপরি যে মানুষের সামাজিক যোগাযোগ যত পোক্ত হবে, তিনি সামাজিকভাবে তত বেশি স্বাস্থ্যবান হবেন। তাই নিজের যোগাযোগ বাড়াতে চেষ্টা থাকতে হবে।