আপনারও কি এমন ক্লান্ত লাগে?

মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ আপনাকে কেবলই ক্লান্ত করবে। মডেল: সুলতানা
ছবি: কবির হোসেন

ঝিনাদহের একটি এনজিওতে কাজ করেন রেশমা তাসনিম। সকাল সাতটায় উঠে রান্না সেরে একমাত্র মেয়েকে স্কুলে দিয়ে চলে যান অফিস। অফিসে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন রেশমা। বাড়ি ফিরে আর কিছুই করতে মন চায় না। ছুটির দিনে বিছানাই ছাড়তে ইচ্ছা করে না। রেশমা বললেন, ‘আমি যে কম ঘুমাই, তা–ও কিন্তু না। ৮-৯ ঘণ্টা ঘুমিয়েও আমার ক্লান্ত লাগে। মনে হয়, সারা দিন শুয়ে থাকি।’

উৎসব বিশ্বাস পড়াশোনা করেন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাস, ল্যাব শেষে সন্ধ্যায় একটা টিউশন। প্রতিদিন ঘুম ভেঙেই তাঁর মনে হয়, আজ যদি ক্লাসে যাওয়া না লাগত! ক্লাস শেষ করে মনে হয়, আজ আর টিউশনে যাবেন না। কারণ? ক্লান্ত লাগে। ক্লান্ত যে কেবল আপনার বা আমারই লাগে, তা নয়। বিশ্বের সব মানুষের ভেতর যদি কোনো সাধারণ বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে, তাহলে এটাই যে তাঁদের অনেকেরই প্রতিদিন ক্লান্ত লাগে! কিন্তু কেন? ‘হোয়াই আই অ্যাম সো টায়ার্ড’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে রিডার্স ডাইজেস্ট সাময়িকী। ক্লান্ত হওয়ার কারণ আর তার সমাধানগুলো জেনে নেওয়া যাক।

অফিসে বসে থাকেন, তবু আপনার ক্লান্তি যাবে না। মডেল: সুলতানা

১. শুয়ে–বসে থাকা

আপনি সারা দিন নেটফ্লিক্সের সামনে আধশোয়া হয়ে বসে থাকেন। অফিসে বসে থাকেন। ঘরে শুয়ে থাকেন। তবু আপনার ক্লান্তি যায় না। বাস্তবতা হলো, আপনার এই ক্লান্তিভাব কোনো দিনও যাবে না। কেননা, ক্লান্তি দূর করতে শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার কোনো বিকল্প নেই। ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়ার একটি গবেষণা জানাচ্ছে, মাত্র ১০ মিনিটের শারীরিক পরিশ্রম আপনাকে কর্মক্ষম করবে। আর আপনি যদি সপ্তাহে তিন দিন মাত্র ২০ মিনিট ব্যায়াম করেন, সেটা আপনার কর্মক্ষমতা বাড়াবে শতকরা ২০ শতাংশ। ব্যায়াম আমাদের কোষের ‘শক্তিকেন্দ্র’ মাইটোকন্ড্রিয়াকে সক্রিয় করে। যেটি আমাদের পেশিতে শক্তি জোগায়।

২. নিজেকে চাপের ভেতর রাখা

আপনার যদি মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ থাকে, তা আপনাকে কেবলই ক্লান্ত করবে। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়া খুবই জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রে ‘থার্ড ফ্যাক্টর’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা যাতে আরও কর্মদক্ষ হয়, সেই বিষয়ে পরামর্শ দেয় তারা। থার্ড ফ্যাক্টরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেন জেনসেন বলেন, ‘একটানা কাজ করলে ক্লান্তি আপনাকে গ্রাস করবেই। তাই প্রতি ৯০ মিনিটে আপনাকে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বিরতি নিতেই হবে।’ ডেন আরও জানান, বিরতিতে সহকর্মীদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে পারেন। বিরতিতে আপনি হাঁটতে পারেন, পাজল বা সুডোকু মেলাতে পারেন। ফোন করতে পারেন প্রিয়জনকে। আবার ধরুন, কফি বানিয়ে নিজেও খেলেন, পাশের সহকর্মীকেও দিলেন।

ক্লান্ত থাকলে প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারেন। মডেল: লাবণ্য

৩. আপনি কি হতাশ, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?

আপনি যখন হতাশ বা চিন্তিত থাকেন, তখন আপনার শরীর খুবই সতর্ক থাকে। এ সময়ে শরীর এড্রিনালিন হরমোন নিঃসৃত করে। মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। আর মস্তিষ্ক যেকোনো পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য তৈরি থাকে। এই সব প্রক্রিয়ায় অনেকখানি শক্তি বাজে খরচ হয়ে যায়। পরিণতিতে আপনার ক্লান্ত লাগে। আর এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না থাকার সুযোগ নেই। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, নিরাপত্তাহীনতা, বিদ্যুৎ–বিভ্রাট, যানজট—সংকটের তালিকার যেন শুরু আছে, শেষ নেই। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা মহামারির আগে প্রতি ১০০ জনে ৮ জন হতাশায় ভুগছিলেন। আর মহামারিকাল পেরিয়ে সেই সংখ্যা পৌঁছেছে ২৮! আমাদের দেশে যদিও এমন কোনো গবেষণা নেই, তবে আন্দাজ করা যায়, হতাশার শতকরা হার যুক্তরাষ্ট্র থেকে কম হবে না।

ব্রিটিশ জার্নাল অব সাইকোলজি জানাচ্ছে, নিয়মিত নেতিবাচক খবর দেখলে নিজের ব্যক্তিগত অসুবিধা নিয়ে আপনি আরও বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির আরেকটি গবেষণা বলছে, যে যত বেশি সামাজিক জীবনযাপন করে, সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত রাখে, সে তত দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা যেকোনো মানুষের সঙ্গে আড্ডার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া থেরাপি আর মেডিটেশন তো আছেই।

৪. ভিটামিনের অভাব

আয়রন আর ভিটামিন বি—বিশেষ করে এই দুইয়ের ঘাটতিতে আমাদের শরীর সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের প্রধান পুষ্টিবিদ ডা. লিন বলেন, ‘অক্সিজেন লোহিত রক্তকণিকায় পৌঁছে শক্তি উৎপাদন করে। অক্সিজেন যত লোহিত রক্তকণিকায় পৌঁছাবে, তত শক্তি উৎপন্ন হবে। ফলে আয়রনের অভাবে যখন লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যাবে, স্বাভাবিকভাবেই শক্তি উৎপাদন কমে যাবে। যার থেকে ক্লান্ত লাগার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, অনিদ্রা বা হৃৎস্পন্দন বেড়ে হাত-পা ঠান্ডাও হয়ে যেতে পারে।’

সামুদ্রিক মাছ খেলে ভিটামিন বি মেলে

ভিটামিন বি (বিশেষ করে বি ১২) লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনের আরেকটি সহায়ক উপাদান। এই দুইয়ের যাতে অভাব না ঘটে, এ জন্য নিয়মিত লাল মাংস, কলিজা, কচুজাতীয় খাবার, বেদানা ও সামুদ্রিক মাছ খেতে হবে। ডাক্তার দেখিয়ে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে সম্পূরকও (সাপ্লিমেন্ট) নেওয়া যেতে পারে।

৫. সুষম খাবারের অভাব

আমরা যখন খাই, ভাবি যে, এই খাবার আমার ওজনে কেমন প্রভাব ফেলবে। অথচ শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও খাবারের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। খাবার হজম হয়ে গ্লুকোজে পরিণত হয়। সেই গ্লুকোজ রক্তের মাধ্যমে শরীরের সব পেশি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর মস্তিষ্কে প্রবাহিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই রক্তে শর্করা কমে যায়। ফলে আমাদের দুর্বল লাগে। তাই আপনি যদি তিন বেলার খাবারকে ছোট ছোট করে ছয় ভাগে খান, তখন প্রক্রিয়াটা দিনব্যাপী চলমান থাকে। হঠাৎ করে সুগার ফল করার আশঙ্কা থাকে না।

আবার আপনি যখন সহজে পরিপাকযোগ্য কার্ব, যেমন জুস, ক্যান্ডি, চকলেট, পাউরুটি খান, এগুলো তাৎক্ষণিকভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। হুট করেই আপনার শরীরে শক্তি ভর করে। শরীরও সেই শর্করাকে ভাঙতে তড়িঘড়ি বেশি মাত্রায় ইনসুলিন উৎপাদন করে। ফলে ‘সুগার ফল’ করে। আর আপনার কর্মশক্তিতে ভরপুর অনুভূতিটা টেকসই হয় না। তাই তুলনামূলকভাবে জটিল কার্ব খান। যেটা হজম হতে কিছুটা সময় নেয়। এতে আপনার কর্মক্ষম অনুভূতিটা টেকসই হবে।

৬. থাইরয়েডের সমস্যা

আপনার ঘাড়ের ভেতর প্রজাপতির মতো দেখতে একটি গ্রন্থি আছে। সেই গ্রন্থি থেকে হরমোনের নিঃসরণ কমে গেলে দেখা দেয় থাইরয়েডের সমস্যা। ফলে আপনার সারা দিন ক্লান্ত লাগে। ডা. লিন বলেন, ‘থাইরয়েড হরমোনগুলো মেটাবলিজমের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর মেটাবলিজম সিস্টেম হলো আপনার শরীরের ইঞ্জিন। গাড়ির ইঞ্জিন ঠিকমতো কাজ না করলে গাড়ি যেমন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। শরীরেরও তাই। মেটাবলিজম সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটলে কর্মক্ষমতা হারায় আমাদের শরীর।’

ষাটোর্ধ্ব নারীদের ক্ষেত্রে থাইরয়েডের সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। এর ফলে ওজন বাড়ে, চলাফেরা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে, ঠান্ডায় সংবেদনশীলতা বাড়ে। সমাধানে আপনি চিকিৎসকের পরামর্শমতো প্রাকৃতিক বা সিনথেটিক থাইরয়েড গ্রহণ করতে পারেন। প্রতিদিন ৪৫ মিনিট টানা হাঁটলেও ভালো ফল দেবে।

এ ছাড়া ঘুমের ভেতর শ্বাসপ্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটলে বা স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলেও আপনার সারা দিন ক্লান্ত লাগতে পারে।