প্রাত্যহিক কর্মচাঞ্চল্যে মুখর উঠানটা আজ হয়তো বানের জলে থইথই। কেউ বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ আবার আশ্রয় নিয়েছেন বাড়ির ছাদে। বিপর্যস্ত জীবনের সবটাই এলোমেলো। বাংলাদেশের আধা কোটিরও বেশি মানুষ এই আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। বিনষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। পানি নামতে শুরু করার পর নতুন করে জীবন গুছিয়ে নেওয়াটা আরেক চ্যালেঞ্জ। চিরচেনা ঘরের অনেক কিছুই এ সময়টায় অচেনা হয়ে পড়ে। নিজের ঘরটাকেও মনে হয় অনিরাপদ। স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নানাবিধ অনিরাপত্তার মাঝেই জীবনটাকে স্বাভাবিক করে তোলার প্রয়াস চালাতে হয়।
রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নওসাবাহ নূর বলেন, ‘বন্যার সময় নানা রকম আবর্জনা ভেসে আসে। মানববর্জ্য, পশুর বর্জ্য তো বটেই, কীটনাশক বা অন্যান্য রাসায়নিক উপকরণও ভেসে আসে পানির সঙ্গে। ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড আর জন্ডিসের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। শ্বাসতন্ত্র ও ত্বকের সংক্রমণও হয়ে থাকে। এই সময়ে হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে এসব রোগ অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা যায়।’
এই সময়ে নিরাপদ পানি ও খাবারের ব্যবস্থা, আবাসস্থল পরিষ্কার করা এবং জমে থাকা পানি ও ক্ষতিগ্রস্ত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হাঁচিকাশির আদবকেতা মেনে চলতে হবে। মশাবাহিত রোগও বাড়তে পারে। তাই মশারির ব্যবহার আবশ্যক। ধারালো জিনিসের ছোটখাটো আঘাত থেকে বড় ধরনের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। আর যাঁরা আগে থেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত, তাঁদের নিয়মমাফিক ওষুধ সেবন নিশ্চিত করার ব্যাপারেও জোর দিলেন এই চিকিৎসক।
বাড়িঘর ঠিকঠাক
গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ও এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সেলিনা আখতার বলেন, ‘বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নিজ বাড়িতে ফিরে বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য ও জ্বালানির সংকটে পড়েন মানুষ। ঘরবাড়ি আর আশপাশের এলাকা পরিষ্কার করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। বসবাসের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়া ঘরটিকেও নতুনভাবে গুছিয়ে নিতে হয়। বন্যার পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা, এমনকি কীটপতঙ্গ বা সাপও ঘরে ঢুকে যেতে পারে। পানি নেমে যাওয়ার পরেও ঘরের কোণে বা আসবাবের পেছনে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে এ ধরনের জীব। তাই ঘর, বারান্দা, উঠান এবং আশপাশ সাবধানে পরিষ্কার করতে হবে।’
নিত্যব্যবহার্য বহু জিনিস আর ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। বাকি জিনিস ব্যবহারের আগে সচেতনতামূলক কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তাঁর কাছ থেকেই জেনে নেওয়া যাক—
যা কিছু বন্যার পানির সংস্পর্শে এসেছে, সবই পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা জরুরি, ঘরের মেঝে এবং আসবাবপত্র পর্যন্ত। যেগুলো ধোয়া সম্ভব, সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। যেগুলো ধোয়া সম্ভব নয়, সেগুলো কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে চেষ্টা করুন, সাবান-পানি বা জীবাণুনাশক দ্রবণ দিয়ে মুছে ফেলুন। সাবান ব্যবহারের পর পুনরায় পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। তবে যেসব সামগ্রী পানি শোষণ করে, যেমন বালিশ, গদি, তোষক প্রভৃতি ফেলে দেওয়াই নিরাপদ।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যেকোনো কাজ করার সময় মাস্ক এবং রাবারের গ্লাভস পরে থাকার চেষ্টা করুন।
জানালা-দরজা খুলে দিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা জরুরি।
রান্নাবান্নার আগে চুলা পরিষ্কার করা জরুরি। মেরামত করার প্রয়োজনও পড়তে পারে। গ্যাসের চুলা ব্যবহারের আগে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।
কোথাও ছত্রাক জন্মে গেলে ছত্রাকনাশক দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
পানি নেমে গেলে বাড়ির আশপাশে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিন।
ঘরের খাবারদাবার
গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শম্পা শারমিন খান বলছিলেন, কোনো খাবার বন্যার পানিতে ভিজে গেলে তা আর নিরাপদ থাকে না। বন্যার পানির সংস্পর্শে আসা ফলমূল, শাকসবজিও আর খাওয়া ঠিক না। অন্য যেসব খাবার ব্যবহার করা যাবে বলে মনে হবে, সেগুলোর ঘ্রাণ, রং আর অবস্থাও যাচাই করে নিতে হবে। খাওয়ার আগে খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে ফুটিয়ে নিতে হবে। মুখবন্ধ প্যাকেটজাত খাবার ভিজে গেলে প্যাকেট খুলে দেখতে হবে ভেতরটা ভালো আছে কি না। ভালো থাকলে অন্য বয়ামে খাবারটা তুলে নিয়ে প্যাকেটটা ফেলে দিন। প্যাকেটের গায়ে লেখা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখটা বয়ামে লিখে রাখুন।
পানিজনিত বিপদ
পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি তো রয়েছেই। নিরাপদ পানির সংকট কাটাতে পানি বিশুদ্ধকরণের বিকল্প ব্যবস্থাগুলো কাজে লাগানোর পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা। ফিটকিরি ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট কাজে লাগানো যেতে পারে। বাড়ির কাছে টিউবওয়েল থাকলে তা ব্যবহারের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলুন। তা ছাড়া পিচ্ছিল মেঝেতে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। আশপাশে জমে থাকা পানিতে শিশু ও প্রাণীরা দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। তাই সতর্ক থাকুন।
বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও ধারালো বস্তু
ভেজা মাটিতে বৈদ্যুতিক তার কিংবা ধারালো জিনিস পড়ে থাকতে পারে। তাই হাঁটচলা করতে হবে সাবধানে। যেখানে–সেখানে হাত দেওয়া যাবে না। সতর্ক থাকতে হবে। বিদ্যুতের মূল সংযোগ বন্ধ না করে বৈদ্যুতিক তার সরানো যাবে না। তা ছাড়া ফ্রিজসহ নানা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বন্যার পানিতে। এগুলো চালু করার আগে পেশাদার ব্যক্তির সহায়তা নিন।
শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. তাসনুভা খান বলছিলেন, রোগবালাই এবং নানাবিধ দুর্ঘটনায় এ সময় বিপন্ন হতে পারে শিশু। এমন বিরূপ পরিস্থিতিতেও তাই শিশুদের দিকে বাড়তি খেয়াল রাখা আবশ্যক। ছোট শিশু যাতে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে না ফেলে, বিপজ্জনক বস্তু (বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম) বা বিপজ্জনক প্রাণীর কাছাকাছি চলে না যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। শিশুর বোতল-বাটি, খেলনা, পোশাকসহ সবকিছু বিশেষ যত্নের সঙ্গে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। শিশুর খাবারদাবার এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতিও যত্নশীল হতে হবে। খাবার স্যালাইন এবং শিশুর জরুরি ওষুধ সঙ্গে রাখুন। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং বাড়ির আশপাশে থাকা প্রাণীদেরও যত্ন নিতে হবে।