পাঠকের কাছ থেকে সন্তান পালন, মনোজগৎ ও ব্যক্তিজীবনের সমস্যা নিয়ে পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমি দেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমার বয়স ৩৭ বছর। বিবাহিত। আমি নিঃসন্তান। সাত বছর ধরে আমি মা হওয়ার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে স্বামীর সঙ্গে আমার অনেক ঝামেলা হয়েছে। ২০২০ সালে প্রতারণা করা অবস্থায় তাকে আমি ধরে ফেলি, কিন্তু প্রযুক্তিগত দিক থেকে সে আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে বলে পরিবারের সামনে তা প্রমাণ করতে পারিনি। দিন শেষে তার পরিবার উল্টো আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করে। ওই ঘটনার পরও আমার স্বামী আমার সঙ্গে একই রুমেই থাকে। পরিবার বলে, বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিবারের কথায় সম্প্রতি আইভিএফ পদ্ধতিতে গর্ভধারণ করেছি, তিন মাস চলছে। এখানেও সে এক টাকা দিয়েও সাহায্য করেনি।
পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করায় আমার পরিবারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এখন গর্ভবতী অবস্থায় আমার যেটুকু না করলেই নয়, সেটুকুই সে করে। কিন্তু আমাকে কোনো মানসিক সাপোর্ট দেয় না। আমি জানি, এখনো কারও সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। কিন্তু প্রমাণ না থাকায় কিছু করতে পারছি না। এ অবস্থায় আমার কী করা উচিত?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: চিঠি পড়েই বোঝা যাচ্ছে, সব দিক থেকেই তুমি কত অসহায়। ঠিক কত দিন ধরে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে, পরিষ্কার না। সেটি কি সাত বছর ধরে তুমি যে গর্ভধারণ করার প্রয়াস করছ, তখন থেকে? যদি তা–ই হয়, তাহলে তুমি কি সন্তান ধারণ করতে চেয়েছ, শুধু সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে? আমার মনঃপীড়া হচ্ছে এই ভেবে যে একটি ছোট্ট শিশু পৃথিবীতে এসে প্রাপ্তবয়স্ক মা–বাবার সম্পর্ক ঠিক করে দেবে, এই মস্ত বড় ভুল ধারণাটি আমরা এই যুগেও বিশ্বাস করছি।
বাস্তবতা হচ্ছে, সন্তানকে পৃথিবীতে আনার আগে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার অঙ্গীকারকে নিশ্চিত করা। বিজ্ঞানীদের মতে, সন্তানের সঠিক বিকাশের জন্য প্রথম সাত-আট বছরের সময়টি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, শৈশবে ঘটে যাওয়া নেতিবাচক অভিজ্ঞতার জের মানুষ সারা জীবন বয়ে বেড়ায় এবং পরে মানসিক অসুস্থতাও দেখা দিতে পারে।
সন্তান এসে মা–বাবার সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবে, এই ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে একটি মানবশিশু যত ছোট থাকুক না কেন, তার আবেগীয় পরিবেশটি যদি নেতিবাচক হয়, সেটা তার অত্যন্ত দ্রুত বিকশিত হতে থাকা মস্তিষ্কের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে। তোমার স্বামীর পরিবারের সদস্যদের মতামত গবেষণায় পাওয়া ফলাফলের বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে।
তবে আমার অনুরোধ, এ কথাগুলো ভেবে তুমি অন্তত নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। এই বিশেষ সময়টিতে নিজের মনটাকে ভালো রেখে কীভাবে চলা যায়, সেটি বেশি জরুরি। আর একটি বিষয়, তোমার কি নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আগে থেকেই দূরত্ব ছিল? তোমাকে কি একটু কড়া শাসনে বড় হতে হয়েছে? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোতে বিয়ের পর মেয়েদের নিজের পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। এটি না থাকলে বিয়ের পর অনেক সময় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাদের অবহেলা করার সুযোগ পেয়ে যায়। মেয়েদের মা–বাবার দিক থেকেও সন্তানের সম্পর্কটি অটুট রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আজকাল তো অনেক মেয়েরাই মা–বাবার অমতে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে, কিন্তু তাই বলে তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়াটা মোটেও সমীচীন নয়। কারণ, সন্তান তো নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসেনি, নিজেদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করার জন্য বাবা-মা সন্তানদের জন্ম দিয়ে থাকেন। শুধু নিজের পছন্দে বিয়ে করার জন্য তারা যদি তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে থাকেন, সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
সন্তান ভুল করতেই পারে, কিন্তু অভিভাবকদের দায়িত্ব হচ্ছে, রাগ-অভিমান ভুলে তাকে কাছে টেনে নেওয়া। তুমি কি চেষ্টা করেছিলে তাদের মান ভাঙাতে বা ক্ষমা চেয়ে নিজের ভুল স্বীকার করতে? সেটি যদি না করে থাকো তাহলে এখন কি সুযোগ আছে? যে বাবা-মা তোমাকে পৃথিবীতে এনেছেন, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে তোমার এ অসহায়ত্ব অনেকটা কাটতে পারে বলে মনে হয়।
স্বামীর পরিবারের লোকজন একটি ভুল বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তোমাকে বিভ্রান্ত করছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, সন্তান জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে তুমি যে কঠিন চিকিৎসাপদ্ধতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছ, সেটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। সেখানে আবার তোমার স্বামীর অর্থনৈতিক সহায়তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ মুহূর্তে তুমি কাঙ্ক্ষিত সন্তানকে নিজের ভেতরে ধারণ করছ এবং এ জন্য তোমাকে অনেক শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সইতে হচ্ছে।
এখন তোমার সবচেয়ে বড় কাজ হবে, স্বার্থপরের মতো নিজের মন ও শরীরের যত্ন নেওয়া। সব দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে কিছু ব্যায়াম অনুশীলন করবে একেবারে নিয়ম করে। এগুলো হচ্ছে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের রিলাক্সেশন ব্যায়াম, মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন এবং পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম। মেডিটেশনটি নিয়মিত করলে অতীতের কষ্টগুলো ছাড়াও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ও ধীরে ধীরে কমে যাবে। এই অনুশীলনগুলো তুমি ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে খুঁজে বের করে নিয়ো।
তোমার নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন হলে আশা করি তুমি কিছুটা শক্তি পাবে। অনাগত সন্তানটির সঙ্গে মায়ের পরিবারের নৈকট্য সন্তানের বিকাশের জন্য যে সহায়ক হবে, তাতে সন্দেহ নেই।