পড়া না পারলে হেড স্যার বলতেন, ‘বাবা, তোমার কান ধরি না চুল ধরি’

হরিপ্রসাদ শীল আমার বন্ধু। ওর বাবা নগেন অধিকারী কাকা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। হরি আর আমি প্রাইমারিতে একসঙ্গে পড়তাম। ওর গ্রাম লোহাগড়া থেকে আমাদের স্কুল মাইলখানেক। বাঁ হাতে বই আর পকেটে চালভাজা নিয়ে কাশিবাড়ি, গাইনডুবি, পাটাগড়া, বাদমিছিল হয়ে স্কুলে আসত হরি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে কুড়মুড় করে চালভাজা চিবাত। মাঝেমধ্যে আমাকেও দিত। আমার ঠিক পেছনের বেঞ্চে বসত হরি। লিখতে গিয়ে ওর হাত কাঁপত। পড়া না পারলে হেড স্যার ওর কাছে গিয়ে বলতেন, ‘বাবা হরি, তোমার কান ধরি না চুল ধরি।’ হরিও কম কিসে; মৃদু হেসে সেও বলত, ‘কানটাই ধরেন স্যার, চুল ধরলে ব্যথা পাই।’ এমন মধুর বাহাসে হাসির রোল পড়ে যেত গোটা ক্লাসে।

খুব ছোটবেলায় এতিম হয়ে যায় হরি। জন্মের ১৫ দিনের মধ্যেই কাকিমা ওপারে পাড়ি জমান। এর ফলে প্রাইমারির গণ্ডিতেই থেমে যায় ওর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন।

এবার ঈদের পরদিন টেপারাম কাকার চা–দোকানে হরিসহ আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। টেপা কাকা অসুস্থ। তাঁর স্ত্রী রবিবালা খুব যত্ন করে আমাদের চা খাওয়ালেন। লোহাগড়া হাটের শতবর্ষী শিমুলগাছ, দেবীর মাঠ, হরি বাসর মন্দির, শ্মশানঘাট—সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর লোহাগড়া হাটের করুণ দশা দেখে খুব খারাপ লাগল। অতি প্রাচীন এই হাট এখন পূর্বদিকে অনেকটা সরে গিয়ে চৌরঙ্গী বাজার নাম ধারণ করেছে। সবাই এই নতুন বাজারে দোকান স্থানান্তর করলেও শিকড়কে ভোলেননি ফাগু পাঞ্জিয়ার, পঞ্চমরাম দরজি, ঘুটু পানোয়ার, নেতাজি চাচারা। পুরোনো এই জায়গাতেই এখনো পড়ে আছেন তাঁরা ওই শতবর্ষী শিমুলগাছটার মতো।

বন্ধুদের আড্ডায় লেখক ও হরিপ্রসাদ শীল (বাঁ থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয়)

সূর্য মাথার ওপরে উঠে যায়। দ্রুত ফুরিয়ে আসে আড্ডার সময়। সামনে পূজায় ওর জন্য কী পাঠাব, আস্তে করে জানতে চাই হরির কাছে। চুপ থাকে হরি। শুধু অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ‘তুই যে আমার খবর নিতে এসেছিস, আমাদের মনে রেখেছিস, এর চেয়ে বড় কোনো চাওয়াপাওয়া আর কী আছে বন্ধু?’ একটু পরে আমার খুব কাছে এসে বিড়বিড় করে একটা কথা বলে হরি। আজ সকালে প্রার্থনায় নাকি আমার ছবি ভেসে উঠেছিল তার চোখে। আমার জন্য তার ভগবানের কাছে অনেক কিছু সে চেয়েছে। আমি একটু থামি, ওর চোখের দিকে তাকাই। অন্যদিকে তাকায় ও। মন কেমনের ছবি আরও স্পষ্টতর হয়। ওর গায়ে হাত রাখি, বলি,‘হরি, চলি।’

হরি কোনো কথা বলে না। স্কুলে ছোটবেলায় লিখতে গিয়ে যেমন হাত কাঁপত, তেমনি ওর চোখ কাঁপছে আজ। চোখের কোনা ভিজে উঠছে নোনা জলে। মনে হলো, এই সব ভালোবাসা মিছে নয়, মিছে নয়।

আমি আর কথা বাড়াই না। বাড়ির পথ ধরি। মনে পড়ে যায় হরির স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সেই ছবিটা—একটি মা-মরা ছেলে, বিষণ্ন মন, শুকনা মুখ, চালভাজাহীন শূন্য পকেট, বাঁ হাতে বই, সরু আলপথ, ধীরে ধীরে কাশিবাড়ির হাজারো সাদা কাশফুলে মিলিয়ে যাচ্ছে লোহাগড়ার পথ।

লেখক: অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ