‘ভুল থেকে শিখছি’, কথাটা যে স্রেফ ‘কথার কথা’ নয়, প্রমাণ করেছে ইউআইইউ মার্স রোভার। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) শিক্ষার্থীদের এই দলের ধারাবাহিক উন্নতিটা বেশ চোখে পড়ার মতো।
২০২২ সালে ১৩তম। ২০২৩-এ নবম। আর ২০২৪ সালে পঞ্চম। এই হলো ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ (ইউআরসি) প্রতিযোগিতায় ইউআইইউ মার্স রোভারের তিন বছরের ফল। টানা তিনবার দলটি শুধু যে এশিয়াতেই প্রথম হয়েছে তা নয়, র্যাঙ্কিংয়েও এসেছে ধারাবাহিক সাফল্য।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপন করতে যাচ্ছে মানুষ। কিন্তু সে জন্য চাই আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি রোভার, যেগুলো লালগ্রহকে মানুষের বাসযোগ্য করতে সাহায্য করবে। এমন রোভার তৈরির কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করতেই আয়োজন করা হয় ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ। নাসার অলাভজনক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান দ্য মার্স সোসাইটি এর আয়োজক।
এ বছর ইউআরসিতে অংশ নিয়েছিল ১৫টি দেশের ১০২টি দল। প্রাথমিক বাছাই শেষে সেরা ৩৮ দলকে মূল পর্বে অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়৷ ২৯ মে থেকে ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের হ্যাঙ্কসভিল শহরের মার্স ডেজার্ট রিসার্চ স্টেশনে বসে চূড়ান্ত আসর। বাংলাদেশ থেকে তিনটি দল মূল পর্বে সুযোগ পেলেও শেষ পর্যন্ত দুটি দল ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। অন্য দলটি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্র্যাকইউ মঙ্গল তরী’।
মূলত মঙ্গলগ্রহে গবেষণাকাজে সহায়তা করতে পারবে, এমন রোবট বা রোভার তৈরিই এই প্রতিযোগিতার মূল চ্যালেঞ্জ। রোবটের মাধ্যমে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজা, মাটি সংগ্রহ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বহন, এ রকম নানা ধরনের কাজে সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে হয়। সব মিলিয়ে ৩০৪ দশমিক ২৫ নম্বর পেয়ে এবার পঞ্চম হয়েছে ইউআইইউ মার্স রোভার। ব্র্যাকইউ মঙ্গল তরী হয়েছে ২১তম।
কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল, ব্যবসায় প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগের ৩২ শিক্ষার্থী এই দলের সদস্য। তবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিল ১০ জনের একটি দল।
প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম দলনেতা মো. ইয়াসিনের কাছে। বললেন, ‘প্রতিবছর প্রতিযোগিতা শেষেই আমরা আমাদের ভুল ও উন্নতির জায়গাগুলো চিহ্নিত করি। এরপর দলের সদস্য, পরামর্শক ও উপদেষ্টাদের নিয়ে পরের বছরের পরিকল্পনা করি। এবার যেমন অ্যালুমিনিয়াম কাঠামোর পরিবর্তে কার্বন ফাইবার ব্যবহার করেছি। ফলে রোভারের ওজন অনেকটাই কমানো সম্ভব হয়েছে।’ আরও নানাভাবে নিজেদের রোভারকে আগের চেয়েও উন্নত করেছে শিক্ষার্থীদের দল।
সাফল্যের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতাও বড় ভূমিকা রেখেছে। দলের অন্যতম সদস্য শাহ মেহরাব হোসেন বলেন, ‘আমাদের যাত্রার শুরুর দিকে গবেষণার সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা রুম দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে আমরা রুমটা অত্যাধুনিক সরঞ্জামসমৃদ্ধ একটা ল্যাবে পরিণত করেছি। ফলে আমাদের কাজে গতি বেড়েছে।’
বর্তমানে এ ল্যাবটি সেন্টার ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রোবোটিকস (সিএআইআর) নামে পরিচিত। এখানে রোভার ছাড়াও এরিয়াল রোবোটিকস ও আন্ডারওয়াটার রোবোটিকস নিয়ে গবেষণা হয়। শুধু ল্যাবের সরঞ্জাম দিয়ে নয়, আর্থিক ও অন্য নানা সহযোগিতার মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপদেষ্টা অধ্যাপক সালেকুল ইসলাম ও পরামর্শক আবিদ হোসেনের সহায়তার কথাও আলাদা করে উল্লেখ করেন দলের সদস্যরা।
ইউআইইউ মার্স রোভারের এটি তৃতীয় প্রজন্মের রোবট। নাম ইদ্রাসিল। এই নামের মানে কী? দলের সদস্য শেখ সাকিব হোসেন ব্যাখ্যা করলেন। ‘নর্স পুরাণে প্রাচীন একটি গাছের নাম ইদ্রাসিল। গাছটি বিভিন্ন মহাবিশ্বকে একত্র করে। আমাদের রোভারও সাতটি ছোট ছোট দলের সমন্বিত পরিশ্রমের ফসল। তাই এমন নাম।’
মঙ্গলগ্রহ নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে বানানো হলেও দেশের কিছু কিছু কাজে এই রোভার ব্যবহার করা সম্ভব বলে দাবি করছেন শিক্ষার্থীরা। যেমন কৃষিসংক্রান্ত স্বয়ংক্রিয়করণ, দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া ও পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান, ম্যাপিং ইত্যাদি।