যুক্তরাজ্যের পুলিশের ক্লাসও নেন মেহযেব

মেহযেব চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

মেহযেব চৌধুরীর সিভি দেখলে আপনার মনে হতে পারে, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। যেন ভুল করে একাধিক মানুষের জীবনবৃত্তান্ত এক পৃষ্ঠায় ছাপা হয়ে গেছে!

শুরুতে তিনি আইন নিয়ে পড়েছেন, ব্যারিস্টার হয়েছেন। পাশাপাশি করেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকতা। একদিকে ফরেনসিক বিজ্ঞান ও অপরাধ তদন্ত তাঁর পিএইচডির বিষয়। অন্যদিকে ‘মেগালিথিক’ নামে তাঁর একটা ব্যান্ড আছে, বেরিয়েছে অ্যালবামও।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখেন, স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানান। আবার পুলিশকে তদন্তে সহযোগিতা করতে পারে, এমন রোবটও তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর আঁকা ছবি স্থান পেয়েছে একাধিক প্রদর্শনীতে। অথচ যুক্তরাজ্যের নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহকারী অধ্যাপক ভবিষ্যতে একটি ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবের ব্যবস্থাপক হতে চান। সেই প্রস্তুতিও চলছে পুরোদমে।

মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মেহযেব কীভাবে এত কিছুর সঙ্গে যুক্ত হলেন? জানতে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছিলাম যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এই তরুণ বাঙালির সঙ্গে।

মা-বাবা আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি

‘তোমার যা ইচ্ছে, তুমি তা-ই হতে পারো’—পাঁচ বছর বয়সেই ছেলের মাথায় এই বিশ্বাস বুনে দিয়েছিলেন মা মাহবুবা চৌধুরী। মেহযেব তাই ভাবনার দুনিয়ায় কখনোই কোনো সীমারেখা টানতে চাননি।

মেহযেবের আঁকা ছবি

ছোটবেলা থেকে মা–বাবার অনুপ্রেরণা তো ছিলই, আরও একজন মেহযেবকে অনুপ্রাণিত করেছেন সব সময়। তিনি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। মেহযেব বলছিলেন, ‘আইনস্টাইন, নিউটন, তাঁরা তো মেধাবী বটেই। কিন্তু লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি সবার চেয়ে আলাদা। তিনি একজন উদ্ভাবক, চিত্রশিল্পী, প্রকৌশলী, স্থপতি, কবি, সংগীতশিল্পী…। বাইসাইকেল, হেলিকপ্টার, সাবমেরিন, মিলিটারি ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে অনেক আধুনিক যন্ত্রের নকশা বহু বছর আগেই তিনি এঁকেছিলেন। আমি তাঁকেই সব সময় রোল মডেল মেনে এসেছি। তাই ছোটবেলা থেকে প্রযুক্তি, আইন, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা, চিত্রশিল্প, বিজ্ঞান—যা কিছুই আমাকে টানুক না কেন, আমি জানতাম, স্বপ্নটা পূরণ না করে আমি থামব না।’

মেহযেব মনের ভেতর একটা অপূর্ণ ইচ্ছার তালিকা নিয়ে ঘোরেন। একটা করে ইচ্ছেপূরণ হয়, নতুন অভিজ্ঞতা হয়, আর তালিকায় তিনি টিক চিহ্ন দেন। এভাবে টিক চিহ্ন দিতে দিতে তাঁর ঝোলায় জমা হয়েছে অদ্ভুত, বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা।

লেখালেখির দুনিয়া

মা মাহবুবা চৌধুরী ও বাবা মতিউর রহমান চৌধুরী—দুজনই যেহেতু সাংবাদিক, তাই ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল মেহযেবের। খেলাধুলা ভালো লাগত। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আইন বিষয়ে স্নাতক (এলএলবি) করার সময়ই তিনি বৈশ্বিক স্পোর্টস এন্টারটেইনমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ডিজোনের (তখন নাম ছিল গোল ডটকম) ফুটবলবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর দেশি–বিদেশি আরও নানা পত্রিকার হয়ে ফুটবল নিয়ে লিখেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ কাভার করেছেন। স্পেনের সেস্ক ফাব্রেগাস, শাবি আলোনসো, ইকার ক্যাসিয়াস, জার্মানির মাইকেল বালাকসহ ফুটবল দুনিয়ার বেশ কয়েকজন সুপারস্টারের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ তাঁর হয়েছে।

মেহযেব বলছিলেন, ‘আমি তো একেবারেই তরুণ বয়স থেকে সাংবাদিকতা শুরু করেছি। যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তা হলো, বড় তারকারা কেউই আমাকে বাচ্চা ছেলে হিসেবে দেখেননি। বরং খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলেছেন।’

স্পেনের খেলোয়াড় সেস্ক ফাব্রেগাসের সঙ্গে

তরুণ বয়সে এত বড় নামী ফুটবলারদের কাছাকাছি হতে পারাই তো বড় অ্যাড্রিনালিন ঝড়ের কারণ হওয়ার কথা। এই আকর্ষণ ছেড়ে আবার ফরেনসিক বিজ্ঞান ও অপরাধ তদন্তের মতো কঠিন বিষয়ে ঝুঁকলেন কেন? মেহযেব বলেন, ‘ওই যে বলছিলাম…একের পর এক টিক চিহ্ন দিয়ে যাওয়া। নতুন কিছু করা। সেই আগ্রহ থেকেই বলতে পারেন।’

উদ্ভাবনের উৎসাহে

মেহযেবের বয়স তখন আট। জনি কোয়েস্ট নামের একটা অ্যানিমেটেড সিরিজ সে সময় ভীষণ ভালো লাগত। ভাবতেন, ভার্চ্যুয়াল বাস্তবতায় যদি নানা রকম অ্যাডভেঞ্চার করা যেত, কী দারুণই না হতো। ২০ বছর পর, ২০১৬ সালের এক গ্রীষ্মের বিকেলে আবারও ভাবনাটা মাথায় টোকা দেয়। মেহযেব তখন টিভিতে মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসার তৈরি একটা রোভার দেখছিলেন। যে রোভার মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠ ধরে চলার পথে চতুর্দিকের ভিডিও ধারণ করে।

মেহযেব ভাবলেন, এমন একটা রোবট তৈরি করলে কেমন হয়, যেটা অপরাধ সংঘটনস্থলের (ক্রাইম সিন) ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও ধারণ করবে? তাহলে গোয়েন্দা, পুলিশ, আইনজীবী, বিচারক, সবাই জায়গাটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখার সুযোগ পাবেন।

কাজে লেগে পড়েন মেহযেব। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির পর থেকে যিনি বিজ্ঞান বিভাগের পড়ালেখামুখো হননি, তাঁর জন্য হঠাৎ একটা রোবট বানিয়ে ফেলা কি সহজ কথা? মেহযেব কিন্তু হাল ছাড়েন না। একাই তৈরি করে ফেলেন একটি রোবট। নাম দেন ম্যাবম্যাট (মা মাহবুবা ও বাবা মতিউরের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ)। হাসতে হাসতে মেহযেব বলছিলেন, ‘বই পড়ে, ইউটিউব দেখে, আর প্রচুর ইলেকট্রিক শক খেয়ে আমি রোবটটা বানাতে পেরেছি। দিনের পর দিন লেগে থেকেছি। কোনো তড়িৎ প্রকৌশলী আমার কাজ দেখলে হয়তো বলে বসতেন, তুমি তো সব ভুলভাল কাজ করছ। কিন্তু যেভাবেই হোক, আমি করতে করতে শিখেছি। ফ্রান্স থেকে কিছু যন্ত্রপাতি আনিয়ে একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের রোবটটা বানিয়েছি।’

মেহযেবের তৈরি ম্যাবম্যাট

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) থেকে শুরু করে ডালাসের পুলিশ বিভাগও মেহযেবকে সাধুবাদ জানিয়েছে। বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় ম্যাবম্যাট নিয়ে খবর ছাপা হয়েছে।

জানিয়ে রাখি, নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞানের পাশাপাশি ‘পুলিশিং’ বিষয়েও পড়ান মেহযেব। যুক্তরাজ্যের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্লাস নেন তিনি। শিক্ষকতাটা ভীষণ উপভোগ করেন বলেই হয়তো বেশ কয়েকবার তিনি ‘সেরা শিক্ষক’ হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন।

চলতে চলতে চলচ্চিত্রে

চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় পথচলাটাকে মেহযেব তুলনা করছেন ‘রোলার কোস্টারে’ চড়ে বসার সঙ্গে।

যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় হুট করেই একটা ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পান তিনি। কিন্তু ঘটনাক্রমে বনে যান সিনেমাটোগ্রাফার। সেই থেকে শুরু। বেশ কয়েকটি প্রকল্পে সিনেমাটোগ্রাফার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। মেহযেব কাজ করেছেন, এমন ৫০টির বেশি ছবি আন্তর্জাতিক উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছে।

গ্র্যামিজয়ী গায়িকা ও অভিনেত্রী সিনথিয়া এরিভোর সঙ্গে

ব্রিটিশ একাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টসের (বাফটা) পেশাগত উন্নয়ন ও নেটওয়ার্কিং প্রকল্প—বাফটা ক্রুতেও অংশ নিয়েছেন তিনি। সেখানে মেন্টর হিসেবে পেয়েছেন অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত সিনেমাটোগ্রাফার লিনাস স্যান্ডগ্রেনকে। ‘লা লা ল্যান্ড’, ‘ফার্স্ট ম্যান’–এর মতো ছবিতে কাজ করেছেন লিনাস। বাফটার ক্রুর সুবাদে চলচ্চিত্র জগতের নামী আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে মেহযেবের। এখন নিজেই একটা ছবি তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তিনি।

জীবন বাঁচানোর পরীক্ষা

যেকোনো অচেনা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেই মেহযেব একধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করেন। সুযোগটা কাজে লাগাতে চান। কিন্তু একবার তিনি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। সে গল্পও আমাদের শোনালেন।

বছর কয়েক আগের কথা। এমিরেটসের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরছিলেন। হঠাৎ প্লেনে একজন যাত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন পুরো প্লেনে কোনো চিকিৎসকও ছিলেন না। ক্রুরা খুঁজতে শুরু করলেন, ‘অন্তত মেডিকেল ট্রেইনিং আছে, এমন কেউ কি আছেন?’ হাত তুললেন মেহযেব।

তিনি বলেন, ‘সে সময় আমি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের লেভেল থ্রি ফার্স্ট এইডার ছিলাম। কেউ নেই দেখে আমিই এগিয়ে গেলাম। আমি সাহসী মানুষ। কিন্তু সেদিনের মতো ভয় কোনো দিন পাইনি।’

স্থলে থাকা চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রোগীর রক্তচাপ থেকে শুরু করে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা, সবটাই করতে হয়েছে। ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্য আরেক যাত্রীর কাছ থেকে ওষুধ এনে খাইয়েছেন মেহযেব। বললেন, ‘আমার শুধু ভয় হচ্ছিল, যদি কোনো ভুল হয়ে যেত, আমি তো নিজেকে কোনো দিন ক্ষমতা করতে পারতাম না। যা হোক, শেষ পর্যন্ত বিমান ল্যান্ড করা পর্যন্ত আমরা তাঁর দেখভাল করতে পেরেছি। নামার পর তিনি শক্ত করে আমার হাত ধরলেন। তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। কিন্তু আমার দিকে একটা অদ্ভুত কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। সেই দৃষ্টি আমি কোনো দিন ভুলব না।’