বাঁয়ে দেবাশিষ দাস, ডানে সঞ্জয় কুমার সূত্রধর। পেছনের প্রতিমাটি দেবাশিষের গড়া
বাঁয়ে দেবাশিষ দাস, ডানে সঞ্জয় কুমার সূত্রধর। পেছনের প্রতিমাটি দেবাশিষের গড়া

তাঁরা পড়েন, প্রতিমাও গড়েন

শারদীয় দুর্গাপূজাকে উপলক্ষ করে প্রতিবছর দেশজুড়ে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা বানানোর উৎসব লেগে যায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়েন, এমন অনেক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীও প্রতিমা বানানোর এই কাজে যুক্ত থাকেন। তাঁদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের দেবাশিষ দাস। ভাস্কর্য বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের এই শিক্ষার্থী বললেন, ‘খুব ছোটবেলায়, ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়ার সময়, ঠাম্মার বানানো মাটির চুলা থেকে মাটি তুলে এনে ছোট ছোট প্রতিমা বানানোর চেষ্টা করতাম। ২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় বড় প্রতিমা বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রশিক্ষণ কিংবা পর্যাপ্ত সাহসের অভাবে সে বছর আর করে ওঠা হয়নি। পরের বছর, ২০১৪ সালে ঠাম্মার উৎসাহে বড় আকারের প্রতিমা বানানো শুরু করি। তখনো আমার পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছিল না, কোনো সহকারীও ছিল না। ঠাম্মাই এগিয়ে এসেছেন। বাঁশের কাঠামো দেওয়া, খড় প্যাঁচানো থেকে অবয়ব দেওয়া—সবকিছুতেই সাহায্য করেছেন।’

ঠাম্মার সহায়তায় প্রতিমা তো বানানো হলো। এখন কোনো না কোনো মণ্ডপে তো সেটা দিতে হবে। এগিয়ে এলেন দেবাশিষের মা। তার চেষ্টায় সূর্যতরুণ ক্লাবের নজরে এল দেবাশিষের বানানো প্রতিমা। তাঁরা পছন্দও করল। দেবাশিষের প্রতিমা দিয়েই সেবার ক্লাবের পূজা হয়েছিল।

প্রায় ১০ বছর আগে প্রতিমা বানানো শুরু করেছিলেন বগুড়ার এই তরুণ। সেবার তাঁর বানানো প্রতিমা দেখে সবাই প্রশংসা করেছিল। বেড়েছিল পরিচিতি। এরপর ২০১৬, ২০১৮, ২০২০ এবং সবশেষ ২০২১ সালে বগুড়ার কয়েকটি মণ্ডপে দেবাশিষের বানানো প্রতিমায় পূজা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র দেবাশিষের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সঞ্জয় কুমার সূত্রধরের শুরুর গল্পে মিল আছে। যদিও সঞ্জয়ের শুরুটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। ২০১৫ সালে একটা ফরমায়েশি কাজ দিয়ে প্রতিমা বানানো শুরু করেছিলেন সঞ্জয়, ‘প্রথম প্রতিমাটা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলাতেই পূজা হয়েছিল। এরপর ২০১৬ ও ২০১৮ সালে চারুকলাতেই সরস্বতীর প্রতিমা বানাই। এর মধ্যে প্রথমটির উপাদান ছিল কাগজ। দুটি কাজেই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইয়েরা সহযোগিতা করেছেন।’

চারুকলার শিক্ষার্থী হিসেবে ভাস্কর্য হয়তো আরও বানাতে হয়। কিন্তু প্রতিমা বানানোর সময় বিশেষ কোনো অনুভূতি কি কাজ করে? দেবাশিষ উত্তর দিলেন, ‘বানানোর সময় অনুভব করি, প্রতিমাটি একই সঙ্গে আমার মা এবং মেয়ে। নিজ হাতে তাঁকে আমি গড়ছি, অবয়ব দিচ্ছি—এই অনুভূতি দারুণ। আমার গড়া প্রতিমার চরণে যখন হাজার হাজার ফুল-বেলপাতার অঞ্জলি পড়ে, তখন যে অনুভূতি হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।’

সঞ্জয় সিরাজগঞ্জের ছেলে। পালদের (শিল্পীর) হাতের কাজ দেখেই প্রতিমা বানানোয় আগ্রহ। হোয়াটসঅ্যাপের খুদে বার্তায় তিনি জানালেন, ‘ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে পূজা হতে দেখেছি। পূজার আগে আগে পালবাড়ি থেকে পালেরা এসে আমাদের বাড়িতে প্রতিমা বানিয়ে দিয়ে যেত। আমি বসে বসে পালমশাইয়ের কাজ দেখতাম। কাঠামো থেকে শুরু করে খড়-দড়ি-মাটি থেকে সবশেষে রং করা পর্যন্ত প্রতিটা কাজ খেয়াল করতাম। তখন থেকেই প্রতিমা বানানোর ইচ্ছা।’

দেবাশিষের করা টেরাকোটার কাজ

এই প্রতিমা বানানোর আগ্রহ থেকেই নাকি সঞ্জয়ের চারুকলায় ভর্তি হওয়া। চারুকলার লেখাপড়া এবং প্রতিমা বানানোর ব্যবহারিক জ্ঞানের মধ্যে সামঞ্জস্য কেমন, সম্পূরক প্রশ্নটা চলেই এল। বললেন, ‘চারুকলার পড়াশোনা আর প্রতিমা বানানো—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। চারুকলায় পড়লেই যে কেউ প্রতিমা বানাতে পারবে, বিষয়টা তেমন নয়। তবে হ্যাঁ, প্রতিমা বানানো নিয়ে ছোটবেলায় যে রকম ধারণা ছিল, তা চারুকলায় পড়তে গিয়ে অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে৷’

দুজনের কেউই এবারের পূজায় প্রতিমা বানাননি। দুজনই গবেষণাসংক্রান্ত পড়াশোনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। সামনে সুযোগ পেলে দুজনই আবারও দুর্গাপূজায় প্রতিমা বানাতে চান।