পর্যাপ্ত সবুজ, হাঁটার পথ, খোলামেলা পরিবেশ আর পরিচ্ছন্ন লেক এই এলাকাকে দিয়েছে আলাদা চেহারা
পর্যাপ্ত সবুজ, হাঁটার পথ, খোলামেলা পরিবেশ আর পরিচ্ছন্ন লেক এই এলাকাকে দিয়েছে আলাদা চেহারা

ঢাকার এই এলাকার বাড়িগুলো কেন তিনতলার বেশি নয়, জানেন?

ঢাকার প্রায় সব আবাসিক এলাকা উঁচু ভবনে ঘেরা। বেশির ভাগ জায়গাতে নেই ঠিকঠাক ফুটপাত, খেলার মাঠ বা হাঁটার পথ। ব্যতিক্রম এই এলাকা। দোতলা–তিনতলা বাড়ি, প্রশস্ত রাস্তা, চমৎকার লেক, খোলামেলা হাঁটার জায়গা—কী নেই।

ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কে কুড়িল ফ্লাইওভার–সংলগ্ন অংশে যে স্বাধীনতা ভাস্কর্য, এর পেছনেই নিকুঞ্জ–১ আবাসিক এলাকার প্রবেশপথ। সীমানাপ্রাচীর–ঘেঁষে সুউচ্চ পাম ও খেজুরগাছের সারি। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লেক। স্বচ্ছ পানির লেকটির দুই পাড় সবুজে ঘেরা। পাড় ধরে পাশাপাশি চলেছে ফুটপাত ও সড়ক। সড়কের পাশে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে দোতলা ও তিনতলা দৃষ্টিনন্দন সব বাড়ি।

জানা যায়, নিকুঞ্জ–১ দেশের একমাত্র আবাসিক এলাকা, যেখানে তিনতলার বেশি বাড়ি নেই। ৬৮ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই আবাসিক এলাকায় মোট ৬৩৪টি প্লট রয়েছে। সব কটি প্লটই তিন কাঠা। বাড়িগুলো তিন কাঠা প্লটের ওপর করা। যদিও কেউ কেউ পাশাপাশি দুটি প্লট কিনে ছয় কাঠা জমির ওপর বাড়ি করেছেন, সেই সংখ্যা খুবই কম। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫০টি প্লটে বাড়ি হয়েছে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কারণে নিকুঞ্জ–১ আবাসিক এলাকায় তিনতলার (৪১ ফুট উঁচু) বেশি ভবন করার অনুমতি দেয় না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তাই প্লটমালিকেরা চাইলেও এখানে তিনতলার বেশি ভবন নির্মাণ করতে পারেন না। ফলে এই আবাসিক এলাকায় জনসংখ্যা খুব কম। সেই সঙ্গে তিন দিকে জলাশয়, পর্যাপ্ত গাছপালা, ফাঁকা জায়গা, উন্নত অবকাঠামো, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ও জোরদার নিরাপত্তাব্যবস্থা—সব মিলিয়ে দেশের অন্যতম সেরা আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে নিকুঞ্জ–১।

চোর–ডাকাতের উপদ্রব নেই নিকুঞ্চ–১ আবাসিক এলাকায়

চলতি বছর বঙ্গভবন ছেড়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও এই নিকুঞ্জ–১ আবাসিক এলাকায় উঠেছেন। লেক ড্রাইভ রোডে তাঁর বাড়িটিও তিন কাঠার ওপর, তিনতলা। সাবেক প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সরকারি সাবেক ও বর্তমান আমলা, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বাস এই আবাসিকে।

এই আবাসিক অঞ্চল পরিচালনা করে নিকুঞ্জ (দক্ষিণ) আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাইম আহমেদ বলেন, এই আবাসিক এলাকার বৈশিষ্ট্য হলো, বাসার মালিকেরা এখানে পরিবার নিয়ে বাস করেন, যা দেশের অন্য আবাসিক এলাকায় খুব একটা দেখা যায় না। দেখা যায়, তিনতলার একটি বাড়িতে দু–চারজনের একটি পরিবার বাস করে। তাঁদের সঙ্গে থাকেন গাড়িচালক ও কাজের লোক। ফলে এখানে তিন হাজার থেকে চার হাজারের বেশি লোক বাস করেন না।

কম লোক হওয়ায় সবার সঙ্গে সবার পরিচয় আছে। একজনের বিপদে–আপদে আরেকজনকে পাশে পান। এতে সবার মধ্যে একধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ গড়ে উঠেছে বলেও মনে করেন নাইম আহমেদ।

স্থাপত্য–প্রকৃতির মিশেলে অনন্য

ফাঁকা জায়গার অভাবে ভবনের ঘনত্ব, কোনোটা অনেক উঁচু আবার কোনোটা বেশ নিচু থাকায় ঢাকার ভবনের স্থাপত্যশৈলী নজর এড়িয়ে যায়। নিকুঞ্জ–১ আবাসিক এলাকা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। প্রায় সব বাড়ির স্থাপত্যশৈলী বাইরে থেকে দেখা যায়। স্থাপত্যপ্রেমী কেউ এই এলাকায় প্রবেশ করলে তাঁর পক্ষে থেমে থেমে সব বাসা দেখা ছাড়া এগোনো কঠিন।

নিকুঞ্জ–১ এলাকার বাড়িগুলোতে আছে শৈল্পিক ভাবনা

এখানকার এক বাড়ির স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে আরেকটির মিল নেই। তবে সব বাড়িই যেন মন কাড়ে। কোনো বাড়ি কাচে ঘেরা, কোনো বাড়িতে কংক্রিটের পাশাপাশি কাঠের কাজ, কোনো বাড়ির দেয়াল-ফটক-বারান্দা সব কারুকাজে পূর্ণ। আবার কোনো বাড়ি লতাপাতা ও গাছপালায় ছেয়ে আছে। কোনো বাড়ি সেজেছে ফুলে ফুলে।

প্রত্যেক মালিক যেন নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বাড়িগুলো সাজিয়েছেন। বিশেষ করে বাড়ির সামনের অংশটুকু। কেউ কয়েক ফুট ফাঁকা রেখে সেখানে সবজি চাষ করছেন, কেউ বাড়ির কোনার অংশে লাগিয়েছেন ফুলের গাছ। কেউ বাড়ির সামনে কাঠের স্থাপত্য স্থাপন করেছেন, কেউ বারান্দায় টবে বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউয়ের চাষ করছেন। বাড়ির ছাদগুলোও যেন বনভূমিতে রূপ নিয়েছে। বাড়ির প্রাঙ্গণও সেজেছে ছোট–বড় টবে বাহারি ফুল-লতাপাতা-গাছপালায়।

কোনো কোনো প্লটে নতুন করে ভবন তৈরি হচ্ছে। অনেক প্লট এখনো ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানেও গাছপালা লাগানো হয়েছে কিংবা চাষ করা হচ্ছে নানা সবজির। সড়ক বিভাজকেও আম, কাঁঠাল, কামরাঙা, রেইনট্রিসহ ছোট–বড় অনেক গাছপালা। এই আবাসিক এলাকা ঘুরলে এত প্রজাতির গাছপালা পাওয়া যাবে যে উদ্ভিদবিশেষজ্ঞ না হলে সব চেনা দায়। ফুল, লতাপাতা ও গাছপালায় ফড়িং, শালিক, চড়ুই, কাকসহ নানা প্রজাতির পাখির দেখাও মেলে। সুনসান নীরবতার মাঝে যে কাউকে মুগ্ধ করবে পাখির ডাক।

এই আবাসিক এলাকার রাস্তাগুলো এমন করে করা যে প্রতিটি বাড়িতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সব বাড়ির সামনের সড়কই পাকা।

২১ ডিসেম্বর দুপুরে এই আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ভেতরটা সুনসান নীরব। যেতে যেতে চোখে পড়ল বাড়ির বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছেন কোনো বৃদ্ধ। কোনো বাড়ির সামনে বাঁধা পোষা কুকুর । কখনো কখনো দু–একটা ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে। কিছুক্ষণ পরপর দু-একজন গাড়িচালক, কাজের লোক ও তাঁদের ছেলেমেয়ের দেখা মেলে।

দুটি ফটক ছাড়া প্রবেশ ও বের হওয়ার সুযোগ এখানে নেই। বিনা অনুমতিতে বাইরের কেউ এখানে প্রবেশ করতে পারেন না। ফলে এখানকার ফুটপাত দখল করে কোনো দোকান গড়ে ওঠেনি। নেই কোনো হকারের উৎপাত। নিরাপত্তা নিয়েও কারও মধ্যে শঙ্কা নেই। এই আবাসিক এলাকার নিরাপত্তায় ২৯ সদস্যের একটি নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে।

পুরো এলাকায় একটি মাত্র মুদিদোকান। এখানকার আবাসিক সমিতি একটি বহুমুখী ইউটিলিটি শপ তৈরি করছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সেটা চালু হলে এই মুদিদোকানও তুলে দেওয়া হবে বলে জানা গেল।

লেকের ওপরে আছে এমন কাঠ ও লোহার ব্রিজ

আবাসিক এলাকার উত্তর প্রান্তে সাড়ে তিন হাজার লোকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি মসজিদ রয়েছে। মসজিদের পাশেই সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর একটি কবরস্থান, এই আবাসিকের পরিবারগুলোর সদস্যদেরই শুধু এখানে দাফন করা যায়। প্রতিটি কবর নিবন্ধন করা হয়, যাতে তা শনাক্ত করা যায়।

উত্তর পাশ ছাড়া এই আবাসিক এলাকার তিন দিকেই লেক। তা ছাড়া এখানে একটি পার্ক আছে। আবাসিক কল্যাণ সমিতি নিজস্ব অর্থায়নে পার্কে মাঠ, হাঁটার পথ, টেনিস কোর্ট, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ভলিবল কোর্ট, ইয়োগা সেন্টার নির্মাণ করেছে।

পার্কে হাঁটছিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রকৌশলী মির্জা নজরুল ইসলাম। এই আবাসিক এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে নিজস্ব বাড়িতে ২০১২ সাল থেকে বসবাস করছেন তিনি।

আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের জন্য এমন খোলামেলা পরিবেশ চারিদিকে

মির্জা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তিন দিকে খাল ও পর্যাপ্ত গাছপালা থাকায় ধুলাবালু নেই। পরিবেশ ঠান্ডা থাকে। মহাসড়ক থেকে এই আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করলেই কয়েক ডিগ্রি কম তাপ অনুভূত হয়। এ রকম নিরিবিলি ও পরিবেশবান্ধব আবাসিক এলাকা দেশের আর কোথাও নেই।’

নিরাপত্তা প্রসঙ্গে জানালেন, বাইরের লোক এখানে প্রবেশ করতে পারেন না। ফলে রাস্তায় কেউ কোথাও গাড়ি রেখে গেলেও সারা রাত ওখানে পড়ে থাকবে, কোনো সমস্যা হবে না। মাঠের চারপাশে ওয়াকওয়ে থাকায় সকাল, সন্ধ্যা, রাত এলাকাবাসী হাঁটাহাঁটি করতে পারেন।

বিমানের চলাচল ও মহাসড়কে যানবাহনের শব্দ যাতে সংকট তৈরি না করে, তাই সেটা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে। বাইরের ওসব শব্দ ঘরে পাওয়া যায় না।

‘এখানে একটা বাড়ি থাকলে...’

আবাসিক এলাকাটির তিন দিকেই আছে দৃষ্টিনন্দন লেক

নথিপত্র ঘেঁটে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দ দিতে রাজউক ১৯৯২ সালে আবেদন আহ্বান করে। ১৯৯৭ সালে প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু করে। এরপর এই এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়।

প্লটের মালিকেরা ২০০৪ সালে গঠন করেন নিকুঞ্জ (দক্ষিণ) আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি। তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনের নেতৃত্বে ২১ সদস্যবিশিষ্ট প্রথম কমিটি হয়। তখন থেকে এখনো এই সমিতি এলাকাটিকে বসবাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান  বলেন, নিকুঞ্জের সব জায়গায় পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের একটা ছোঁয়া আছে। পরিকল্পনা মানেই শৃঙ্খলা। চাইলেই যে কেউ ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারেন না।

ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন আবাসন ব্যবসায়ী ও কিছু প্রকৌশলী ব্যবসায়িক স্বার্থে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় শেষ পর্যন্ত ভারসাম্য রাখা যায়নি উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, উচ্চতা নির্ধারিত থাকায় নিকুঞ্জে ভবনগুলো তিনতলার বেশি হয়নি, যা ঢাকার অন্য কোথাও নেই। ফলে যে ধরনের কমিউনিটি নিকুঞ্জে পাওয়া যাবে, তা কখনোই বহুতল ভবন বা অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া যাবে না। এ জন্য নিকুঞ্জ আলাদা। ফলে সেখানে গেলে মনে হয়, এখানে একটা বাড়ি থাকলে কতই–না মধুর হতো!