এইচএসসিতে ছেলেরা পিছিয়ে কেন, উচ্চশিক্ষায় কেন মেয়েদের অংশগ্রহণ কম

এইচএসসিতে মেয়েরা এগিয়ে থাকছে, এটা নিশ্চয়ই সুসংবাদ। তবে ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে কেন? কারণ অনুসন্ধান করতে বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০১০ সাল থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কী মনে করেন? ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী?

উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এখনো অনেক কিছু করার আছে

এইচএসসির ফল প্রকাশের পর নটর ডেম কলেজের দৃশ্য

হাসিবুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০২২ বলছে, দেশে শিশুশ্রম বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ, এবং শিশুশ্রমিকদের ৭৭ শতাংশই ছেলে। আবার একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছেলেই পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশি শ্রমবাজারে। বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে পাড়ি জমানো শ্রমিকদের ৯৬ দশমিক ১ শতাংশই পুরুষ। মধ্যপ্রাচ্য আমাদের মূল শ্রমবাজার, যেখানে প্রচুর দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, এসব শ্রমিকের ৪৭ দশমিক ১৪ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি।

উচ্চমাধ্যমিকের ফলের ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে থাকলেও সার্বিক চিত্রটা কিন্তু এখনো সন্তোষজনক নয়। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩ অনুযায়ী, এখনো ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সে মা হন দেশের ২৮ শতাংশ নারী। আরেক সমীক্ষা অনুসারে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান বিভাগে নারী শিক্ষার্থী ৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে ১ দশমিক ৪৬, মেডিসিনে শূন্য দশমিক ১৬ এবং ফার্মেসি শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এসব তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে আমাদের আরও অনেক কিছু করার আছে।

মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে ছেলেদের ঝরে পড়া রোধ এবং উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো—দুটিই এখন সময়ের দাবি। এই লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষার জনপ্রিয়করণ খুব জরুরি। যদি সম্ভব হয়, একটি অভিন্ন সর্বজনীন কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত।

উপবৃত্তি মেয়েদের উৎসাহিত করেছে, তবে বড় চ্যালেঞ্জ অন্য জায়গায়

উপবৃত্তি চালুর পর থেকে মাধ্যমিকে মেয়েদের ভর্তির হার যেমন বেড়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পাসের হারও বেড়েছে

নাজমুজ্জামান সিফাত, শিক্ষার্থী, এডুকেশন পলিসি অ্যান্ড অ্যানালাইসিস

হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব এডুকেশন

এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ ছিলেন ছাত্রী। সংখ্যায় ছেলেরা ১ শতাংশ এগিয়ে থাকলেও জিপিএ ৫-এ তাঁরা পিছিয়ে।

১৯৯৪ সালে মাধ্যমিকে মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি চালুর পর থেকে মাধ্যমিকে মেয়েদের ভর্তির হার যেমন বেড়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পাসের হারও বেড়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে মেয়েদের শিক্ষায় আমরা যে গুরুত্ব দিয়েছি, তা-ও এ অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। আপাতদৃষ্টে ছেলেদের ফলাফল মেয়েদের চেয়ে দিন দিন খারাপ হচ্ছে মনে হলেও আসলে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের পাসের হার গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে বেড়েছে। অভিভাবকেরা ছেলেদের শিক্ষায় আর আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছেন না বা ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় পড়াশোনা করছেন না, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। উপবৃত্তিসহ নানা প্রণোদনার কারণে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে, মেয়েরা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসছেন, ভালো ফলও করছেন। সেই তুলনায় ছেলেদের জন্য আমরা পর্যাপ্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারিনি। পাশাপাশি ছেলেদের অল্প বয়সে কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতাও আছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। স্নাতক পর্যায়ের আমরা উপজেলায় উপজেলায় কলেজ নিশ্চিত করতে পারলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির বাইরে নতুন শহরে গিয়ে থাকতে হয়। এমনকি আমাদের যে ভর্তির প্রস্তুতি বা কোচিং–সংস্কৃতি, তার জন্যও বাড়ির বাইরে বড় শহরগুলোয় যেতে হয়। আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় আগের চেয়ে পরিবারের সচেতনতা বাড়লেও মেয়েদের ক্ষেত্রে এখনো এটা একটা বাধা। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে পরিবার বেশি চিন্তিত থাকে।

মাধ্যমিকে আমাদের সমস্যাটা কিন্তু শুধু পাসের হারে বা ছেলে-মেয়ের অনুপাতে নয়। মাধ্যমিকে ভর্তির হার অনেক কম, ২০২২–এ ছিল প্রায় ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি আরও কম, ৪৪ শতাংশ; যার মধ্যে ২৩ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার আগেই ঝরে যায়। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে মাধ্যমিক পর্যন্ত অন্তত শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষায় এটাই আপাতত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সন্তানকে সময় দিতে হবে

ফাতিমা জাহান, এইচএসসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবক ও স্কুলশিক্ষক, সাভার

আমি একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াই। আমার স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি। আমার ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা সাধারণত মা-বাবার কথা শুনতে চায় না, আমার ছেলে যদিও ব্যতিক্রম। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। খেলাধুলায়ই ওর আগ্রহ বেশি। তবে আমার কথা শোনে বলেই ও পড়ার সময় পড়াতেই মন দেয়।

সারা দেশের চিত্র যদি বলি, তাহলে বলতে হবে, এখনকার ছেলেরা মুঠোফোনের প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার পারিবারিক কারণে অনেক কর্মজীবনে প্রবেশ করে। এ জন্য ছেলেদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলেও আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরই সচেতন হতে হবে। সন্তানকে বুঝতে হবে, সময় দিতে হবে।

স্কুল-কলেজে খেলাধুলার সুযোগ বাড়ালে নিশ্চয়ই মুঠোফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি কমবে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতেও তারা আগ্রহী হবে। এখন সরকারিভাবে এসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এই সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো উচিত।