স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের রাজকীয় নৌবাহিনীর নাবিক হয়ে গেছেন জামালপুরের মেহেদী হাসান। রণতরিতে করে এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরে ছুটে চলেছেন। কীভাবে ভিনদেশি হয়েও ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সদস্য হলেন এই বাংলাদেশি, মেহেদীর কাছে সেই গল্পই শুনলেন সজীব মিয়া
জিব্রাল্টার প্রণালি ছেড়ে বেশ কিছুদিন স্পেনের জলসীমায় ভেসেছে এইচএমএস ট্রেন্ট। আর দুদিন পরই সামরিক টহল জাহাজটির ইতালির এক বন্দরে পৌঁছানোর কথা। এভাবে ভাসতে ভাসতে দেশের মতো সমুদ্রের মানচিত্রও বদলে গেছে। মেহেদী হাসান অবশ্য তেমন পার্থক্য ঠাহর করতে পারেন না! আটলান্টিক মহাসাগরেও যেমন দেখেছেন পানির মধ্যে থেকে উদিত সূর্যটা দিন শেষে পানিতেই ডুব দিচ্ছে, ভূমধ্যসাগরে ভাসতে ভাসতেও তা-ই দেখছেন।
‘জাহাজি জীবন কি এমনই একঘেয়ে?’
শান্ত সমুদ্রের মতো কথা বলছিলেন মেহেদী। প্রশ্নটা শুনে তাঁর কণ্ঠ চঞ্চল হয়ে উঠল, ‘না, না। এখানে মিলিটারি নিয়ম মেনে আমাদের থাকতে হয়। রুটিন কাজ করতে হয়। নিজেরা আড্ডা দিই। টুকটাক আরও অনেক কাজের ব্যস্ততায় দিন কেটে যায়।’
এইচএমএস ট্রেন্টের নিজস্ব নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থায় ডাঙার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নাবিকেরা। তবে জাহাজের বেশির ভাগ জায়গায় ইন্টারনেটের গতি বেশ ধীর। কথা বলার মতো গতির সঞ্চার হয় জাহাজের প্রশাসনিক কক্ষে এলে। সেখানে বসেই কথা বলছিলেন মেহেদী।
জিব্রাল্টারকে কেন্দ্র করেই নিয়মিত বিভিন্ন গন্তব্যে টহল দেয় যুক্তরাজ্যের সামরিক জাহাজ ট্রেন্ট। গত ১ মে এই টহল জাহাজে যোগ দিয়েছেন মেহেদী। তার আগে যুক্তরাজ্য থেকে বিমানে জিব্রাল্টারে গেছেন। এই মাস দুয়েকের মধ্যেই ট্রেন্টের প্রতি মায়া জন্মে গেছে, জাহাজে থাকা অর্ধশত সহকর্মীর প্রতিও টান তৈরি হয়েছে। হবেই তো, পরিবার–পরিজন ছেড়ে দূর সমুদ্রে এই নাবিকেরাই যে একে অন্যের আপনজন। মেহেদী বলেন, ‘আমরা একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইতালিতে যাচ্ছি। দিন কয়েক থেকে আবার জিব্রাল্টারে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দেব।’
জিব্রাল্টারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে জাহাজে মেহেদীর ১০ সপ্তাহ কেটে যাবে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী এরপরই চার সপ্তাহের ছুটি মিলবে। তখন ফিরে যাবেন যুক্তরাজ্যে।
‘আগে ছুটি পেলে ব্যারাকেই থাকতাম। এবার ছুটি পেলে আর থাকতে হবে না। আমি কোয়ার্টারে বাসা পেয়েছি,’ যোগ করেন মেহেদী।
ক্যাটারিং ও লজিস্টিকস বিভাগের নাবিক হিসেবে ২০১৯ সালে রাজকীয় নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন মেহেদী। প্রশিক্ষণের পর বিভিন্ন ঘাঁটিতে কাজ করেছেন। জাহাজে থেকেছেন কিছুদিন। রান্নার পাশাপাশি জাহাজে তাঁকে খাবার পরিবেশন করতে হয়। মেহেদী বলেন, ‘জাহাজে খাবারদাবারের ব্যাপারটা ভীষণ স্পর্শকাতর। সবার পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে কোন বেলায় কী পদ পরিবেশন করা হবে, তার তালিকা করা আছে। এক বেলার খাবার কোনোভাবেই অন্য বেলায় দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই যত না রান্নার ঝামেলা, তার চেয়ে কঠিন এসব নিয়মনীতি।’ এই কঠিনেরে কীভাবে ভালোবাসলেন, সেই গল্পই শুনতে চাই মেহেদীর কাছে।
২০১৮ সালে স্কাউটের গ্রীষ্মকালীন কর্মসূচিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান মেহেদী হাসান। তিনি তখন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিন মাসের জন্য গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ঘুরে দেখার সুযোগ পান। ঘুরে ঘুরে স্কুলপড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁর সময় কাটত। শিশুদের মধ্যে নিজের স্কাউটজীবনের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতেন। সে সময়ই দেখেন যুক্তরাজ্য স্কাউটের এক কর্মসূচি স্বেচ্ছাসেবক নেবে। আবেদন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মসূচি শেষ করার আগেই জেনে যান, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তাঁকে নির্বাচন করেছে যুক্তরাজ্য স্কাউট।
এক বছরের কর্মসূচি। যার আওতায় স্কুলপড়ুয়াদের হাইকিং, ক্লাইম্বিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চারে হাতেখড়ি দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় ফিরে দ্রুতই লন্ডনের বিমানে ওঠেন মেহেদী। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে শহরের বাইরের একটি সেন্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন মেহেদী।
এক বছরের কর্মসূচির প্রায় ৯ মাস কেটে যায়। মেহেদী ভাবলেন দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশে ফিরবেন, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করতে মনোযোগী হবেন। কিন্তু তার আগেই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন, ‘আশপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, এসব বিষয় জানার আমার তীব্র আগ্রহ। দেশে থাকতেও আমি প্রায়ই সরকারি দপ্তরের ওয়েবসাইট ঘাঁটতাম। কোনো বৃত্তি, কোনো ফেলোশিপের সুযোগ আছে কি না, জানার চেষ্টা করতাম। ঘাঁটাঘাঁটির এই অভ্যাসবশত যুক্তরাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারতাম। এভাবেই একদিন রয়্যাল নৌবাহিনীর বিজ্ঞপ্তিটি পেয়ে যাই।’
যুক্তরাজ্যের রাজকীয় নৌবাহিনীতে নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিয়মিতই লোক নিয়ে থাকে তারা। নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ বছর যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী যে কেউ নাবিক হিসেবে যোগদানের আবেদন করতে পারে। কিন্তু মেহেদী তো গেছেন মাত্র ৯ মাস!
‘সে সময় কমনওয়েলথভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য পাঁচ বছর বসবাসের নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগাতে সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে আবেদন করি,’ বলেন মেহেদী।
রয়্যাল নৌবাহিনী মেহেদীর আবেদন গ্রহণ করে। পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করে। ধাপে ধাপে সব পরীক্ষায় উতরেও যান। বাকি থাকে শুধু চার দিনের প্রি-রয়্যাল নেভি কোর্স। এটা পাস করলেই কেল্লাফতে। কিন্তু তখনই বাধল বিপত্তি।
মেহেদী বলেন, ‘আমি যে সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করি, তারা সাফ জানিয়ে দিল, চার দিন ছুটি দেবে না। ভাবলাম, আমার ভিসার মেয়াদই আছে মাসখানেক, একটা রিস্ক নিয়ে নিই। কাজটা ছেড়ে দিলাম।’
চার দিনের কোর্সে কাপড় ইস্তিরি করা, বিছানা গোছানোর দক্ষতা দেখাসহ শারীরিক পরীক্ষাও হলো। সবকিছুতেই উতরে যান মেহেদী। অবশেষে তাঁকে জানানো হলো যোগদানের তারিখ—২১ জুলাই ২০১৯।
কিন্তু সে তো আরও ১৫ দিন। এই কয় দিন লন্ডনে কই থাকবেন? পকেটে টাকা নেই যে হোটেলে উঠবেন। পরিচিত কেউও নেই, যাঁর বাসায় দু-দশ দিন থাকতে পারবেন। চাকরি পাওয়ার আনন্দটাও তাই করতে পারলেন না। মেহেদী বলছিলেন, ‘বাধ্য হয়ে তখন লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করি। সব শুনে তারা আমাকে আর্থিক সহযোগিতা দিল, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করল। তাদের সহযোগিতায় ২১ জুলাই নেভিতে জয়েন করি।’
চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর মেহেদীর ভিসা জটিলতাও কেটে যায়। সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে তাঁর পাসপোর্টে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিল পড়ে। বসবাসের বিশেষ সুবিধা পান। আর এখন তো কাজের ফাঁকে ইউনিভার্সিটি অব লিংকনে মাস্টার্সও করছেন মেহেদী।
বাংলাদেশের পাসপোর্টেই গত ঈদুল ফিতরে দেশে ঘুরে গেছেন মেহেদী হাসান। জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় তাঁর বাড়ি। বাবা খলিলুর রহমান স্থানীয় একটি স্কুলের অফিস সহকারী। মা সুরাইয়া বেগম গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। মেলান্দহে এসএসসি পাস করে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা করেন মেহেদী।
মেহেদী বলছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম কীভাবে আমাদের পরিবারে পরিবর্তন আনা যায়। আব্বা বলতেন ব্যতিক্রম কিছু করার কথা। ভাবতাম, শুধু পড়াশোনা করে ব্যতিক্রমী কিছু করা যাবে না। তাই বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হয়েছি, মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।’
মেহেদীর স্কুলে স্কাউট করার সুযোগ ছিল না। সেই সুযোগ পান পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার পর। এই প্রতিষ্ঠানের স্কাউট দলের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি। তখন থেকেই বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে।
২০১৬ সালে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাংলাদেশ স্কাউটসের আন্তর্জাতিক কমিটির এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সদস্যসচিবও হয়ে যান একসময়। ইংরেজির চর্চা বাড়ান। বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে থাকেন। এভাবেই একসময় জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগটা আসে। সেই সুযোগই তো মেহেদীকে নিয়ে গেল ফৌজি জীবনে।
মেহেদী বলেন, ‘এই জীবনটা খুব এনজয় করছি। জীবনে যদি আর কিছু না–ও পাই, আফসোস থাকবে না।’