ফারজানার সেই সেঞ্চুরির ভাগীদার গাইবান্ধার বাবলু খানও

১৬০ বলে ১০৭ রান। তার মধ্যে ৭টি চার। মেয়েদের ক্রিকেটে দেশের হয়ে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিক এখন ফারজানা হক। ২২ জুলাই ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে করা ফারজানার সেই সেঞ্চুরির ভাগীদার গাইবান্ধার ক্রিকেট কোচ বাবলু খানও। তাঁর হাতেই যে ফারজানা হকের ক্রিকেটে হাতেখড়ি। ডানহাতি এই উদ্বোধনী ব্যাটার একা নন, জাতীয় নারী দলের আরও দুজন ক্রিকেটার তাঁর ছাত্রী। কোচ বাবলু খানের ২২ গজের মায়ায় জড়িয়ে পড়ার গল্প শুনতে গিয়ে সেই নাম দুটিও জেনেছেন শাহাবুল শাহীনসজীব মিয়া

মেয়েদের ক্রিকেটে দেশের হয়ে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিক এখন ফারজানা হক
ছবি: শামসুল হক

বাজার থেকে ফিরে বিছানায় গা–টা এলিয়ে দিয়েছিলেন। তন্দ্রামতোও এসেছিল। তার মধ্যেই এক প্রশিক্ষণার্থীর ভাইয়ের ফোন, ‘স্যার, কিছু শুনছেন?’

কী শুনবেন বাবলু খান! সারা দিন হবু ক্রিকেটারদের নিয়ে মাঠে কাটিয়েছেন। আর এখন তো বাসাতেই আছেন। তাঁর জীবন বলতেও তো এই মাঠ আর বাসা। ছাত্রছাত্রীদের কারও কিছু হলো না তো। প্রশ্নটা শুনে একটু ভয়ই পেয়ে যান, ‘না, না তো, কী হয়েছে?’

বাবলু খানের উত্তর শুনে ফোনের ওপাশ থেকে আর ভণিতা নয়, অভয়ের হাসি, ‘আপনার পিংকি (ফারজানা হক) তো সেঞ্চুরি করেছে।’

এমন একটা আনন্দের সংবাদ নিয়ে কেউ এত ভণিতা করে। তখনই মনে পড়ে বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যকার খেলার কথা। বাজারে যাওয়ার আগেও খেলা দেখেছেন। নিজের ছাত্রী খারাপ খেললে কষ্ট লাগে, আবার দল হেরে গেলেও কষ্ট পান, তাই একটা সময় পর খেলাটা আর দেখেননি।

গাইবান্ধার ক্রিকেট কোচ বাবলু খান

বুঝলেন বিরাট মিস হয়ে গেছে, মনটাও খারাপ লাগতে শুরু করে। তবে নিমেষে সেটা কেটেও যায়। ‘ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে শত রান, কত বড় রেকর্ড! বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচে আমার ছাত্রী (শারমিন আক্তার) সুপ্তা যখন সেঞ্চুরি করেছিল, তখনো খুশি হইছি। ছাত্রছাত্রী ভালো করলে কোচের তো ভালো লাগেই। গর্বও হয়।’ ২৬ জুলাই প্রতিবেদকের কাছে হাসতে হাসতে বলছিলেন বাবলু খান।

ফারজানা হকের মতো জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের উইকেটকিপার নুজহাত তাসনিয়া ও ব্যাটার শারমিন আক্তারের হাতেখড়িও বাবলু খানের হাতে হয়েছে। তাঁদের মতো হাতেখড়ি নেওয়া আরও তিনজন বর্তমানে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলে খেলছে।

সেঞ্চুরির পর ফারজানার সঙ্গে কী কথা হলো? বাবলু বলেন, কথা তো হয়ই। ঈদের দুই দিন আগেই সে গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় গেছে। আমাকে ঈদে উপহারও পাঠিয়েছে। সেঞ্চুরির পরেও কথা হয়েছে।

গাইবান্ধা শহরেই বাবলু খানদের বাড়ি। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ। ফুটবল খেলতেন খুব। আর বন্ধুরা খেলতেন ক্রিকেট। বাবলু খান ক্রিকেটে ভালো ছিলেন না। এ নিয়ে তাঁকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের টিপ্পনী হজম করতে হতো। একসময় ক্রিকেট মাঠেও ঢুকে পড়েন বাবলু। নিজে নিজে চর্চা করে ভালো অবস্থানও তৈরি করেন। স্কুলে বিভাগীয় পর্যায়েও খেলেছেন। পেস বল করতেন। বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন যখন ডানা মেলতে থাকে, তখনই একদিন হঠাৎ ইনজুরিতে পড়ে যান। বাবলু খান বলেন, ‘আমি তখন ক্রিকেটের নেশায় পড়ে গেছি। পরিবার থেকে পড়াশোনার চাপ দেয়। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিই মানুষ তো অনেক কিছু নিয়েই থাকে, আমি না হয় ক্রিকেট নিয়েই থাকব।’

ফারজানা হকসহ (মাঝে) অন্য প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে বাবলু খান

ডেকে ডেকে আনতেন

২০০০ সাল থেকে কোচিং শুরু করেন বাবলু খান। শুরুতে ছেলে-মেয়েদের বাড়ি থেকে ডেকে ডেকে আনতেন। তারপরও আগ্রহী নারী খেলোয়াড় পেতেন না। অনেক কষ্টে প্রথম পর্যায়ে সাত থেকে আটজন মেয়েকে এনে ক্রিকেটে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। পরে ১২–তে পৌঁছায় এই সংখ্যা। বাবলু খান বর্তমানে গাইবান্ধার ক্রিকেট কোচিং সেন্টারের পরিচালক ও কোচ।

ফারজানা হক কীভাবে তাঁর কোচিংয়ে এলেন, সেই গল্প জানতে চাই। ২০০৫ সালে ফিরে যান তিনি। স্মৃতি হাতড়ে জানান, ফারজানা হকের এক চাচা তাঁর বন্ধু মানুষ। তিনিই ফারজানা হকদের দুই বোনকে কোচিংয়ে নিতে বলেন। ফারজানাদের বাবাকে গিয়ে বুঝিয়ে বলেন বাবলু খান। সায় দিলে তাঁর কোচিংয়ে নিয়ে আসেন। বাবলু খান দেখলেন বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাটিংয়ে ভালো ফারজানা। এভাবেই ব্যাটিংয়ে ফারজানার হাতেখড়ি।

গাইবান্ধা তখনো রাজশাহী বিভাগের অধীন। বিভাগীয় বাছাইপর্বে অংশ নিতে ১২ জনের নারী ক্রিকেট দল নিয়ে রাজশাহী তেরখাদা স্টেডিয়ামে যান বাবলু খান। ১২ জনের মধ্যে ফারজানা হক ও আরেক প্রশিক্ষণার্থী ফারহানা টিকে যান। রাজশাহী বিভাগের হয়ে তাঁরা ঢাকায় জাতীয় ক্রিকেট লিগ খেলতে আসেন।

এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিতে থাকে বাবলু খানের প্রশিক্ষণার্থীরা। সে সময় ঢাকা থেকে দুজন ক্রিকেট কোচ গাইবান্ধায় যান। মেয়েদের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা। ২০০৮ সালে চার ছাত্রীকে ঢাকার বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াতে নিয়ে আসেন বাবলু খান। এর মধ্যে ফারজানা হক, নুজহাত তাসনিয়া ও শারমিন আক্তার সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান। সেই আনন্দের দিনটির কথা কখনো ভুলবেন না বাবলু খান।

বিকেএসপিতে ভর্তির পর নতুনভাবে গড়ে উঠতে থাকেন বাবলু খানের প্রশিক্ষণার্থীরা। একে একে জাতীয় দলে নাম লেখান তাঁরা। সেখানেও নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। গাইবান্ধায় বসে মেয়েদের সাফল্যে গর্বিত হোন বাবলু খান।

কোচ হিসেবে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বাবলু খান। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন জাতীয় দলসহ বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলছেন। এসব প্রশিক্ষণার্থীর সাফল্যের কারণেই এখনো ক্রিকেট মাঠে রয়ে গেছেন বাবলু খান। কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে কত দিন টিকে থাকতে পারবেন, তা নিয়ে মন খারাপ করা কথা শোনালেন এই কোচ, ‘গাইবান্ধায় ক্রিকেট কোচ মোট তিনজন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে জেলা কোচ ছাড়া অন্য দুজনকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। জেলা ক্রীড়া সংস্থা থেকে সামান্য সহযোগিতা মিললেও তা অপ্রতুল। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এদিকে সন্তান বড় হচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ আছে, জানি না কবে কোচিং ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।’