এক কলেজ থেকেই মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৫০ জন!
তথ্যটা আরও বিস্ময়কর লাগবে, যখন জানবেন, ২০২৩ সালে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ৩০০ জন। একই ব্যাচের ৬ ভাগের ১ ভাগ শিক্ষার্থী এমন তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটি পরীক্ষায় টিকে যাওয়া নিশ্চয়ই চাট্টিখানি কথা নয়।
শুধু উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নয়, এডওয়ার্ড কলেজের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও সম্প্রতি এসেছে সুখবর। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৮৮১টি স্নাতক পাঠদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় হয়েছে এই বিদ্যাপীঠ। এসব কারণেই কি এবারের বসন্তে কলেজ ক্যাম্পাসটা একটু বেশি রঙিন!
৪৩ একরের এই প্রাঙ্গণ রঙিন করার পেছনে কৃষ্ণচূড়া, মহুয়া, বকুল, শিমুলগাছগুলোর অবদানও স্বীকার করতে হবে। জাম, লিচু, কড়াইগাছগুলো এখানকার ছাত্রছাত্রীদের ছায়া-মায়ায় ঘিরে রাখে। একদিকে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞান বিভাগের পুরোনো সব ভবন, অন্যদিকে কলা ও বাণিজ্য বিভাগের নতুন ভবনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, স্বপ্ন, গৌরবের হাজারো গল্প যে প্রাঙ্গণে, সেখানেই ঢুঁ মেরেছিলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি।
১৮৯৮ সালে পাবনার শিক্ষানুরাগী গোপালচন্দ্র লাহিড়ী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে নাম ছিল ‘পাবনা ইনস্টিটিউট’। তখন এই কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। ১৯১১ সালে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের প্রতি সম্মান জানিয়ে নাম করা হয় এডওয়ার্ড কলেজ।
১৯৫৪ সালে কলেজটিতে বাংলা ও অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম অনার্স কোর্স চালু হয়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার যখন কলেজটি জাতীয়করণ করে, তখন নাম হয় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ। বর্তমানে এখানে ১৯টি বিষয়ে অনার্স, ১৭টি বিষয়ে মাস্টার্স, বিএ (পাস কোর্স), বিএসএস, বিএসসি ও এইচএসসি চালু আছে। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬ হাজার ৬৪৬। শিক্ষক আছেন ১৪৫ জন। পড়ালেখার পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্যও এই কলেজের শিক্ষার্থীদের সুনাম আছে।
এত বছরের পুরোনো শিক্ষাঙ্গন, স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন অ্যালামনাইরা। তেমনই একজন এইচএসসি ’৮৪ ব্যাচের শহীদুর রহমান। তিনি এখন ডাক্তার জহুরুল কামাল সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। বলছিলেন, ‘কিছুদিন আগেই আমরা একটা পুনর্মিলনী করলাম। আমাদের কলেজের বহু ছাত্র এখন ভালো অবস্থানে আছেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও এই কলেজের ছাত্র। এ ছাড়া সচিব, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও, ব্যাংকারসহ বড় বড় পদে অনেকেই চাকরি করছেন।’
কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষে পড়েছেন শারমিন আখতার। তিনি ৩০তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে এখন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পদে কর্মরত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়েছিলেন শারমিন। পরে বাবার কথায় এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। বলছিলেন, ‘কলেজের দিনগুলো দারুণ ছিল। খুব আন্তরিক শিক্ষক পেয়েছি। তাঁরাই শিখিয়েছিলেন, হতাশ না হতে, লক্ষ্যে স্থির থাকতে। আমি আমার লক্ষ্য স্থির রেখেছিলাম। এখন মনে হয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থী তাঁর লক্ষ্য স্থির রেখে এবং ঠিকমতো পড়ালেখা করলে সফল হতে পারে।’
মামুনুর রশিদ সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ১৯৯৫-৯৬ সেশনে ইংরেজি বিভাগে পড়েছেন। এখন বগুড়া জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্বে আছেন। সম্প্রতি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। কলেজের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু ভালো কলেজে পড়ে বড় মানুষ হননি। নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন। তাই নিজেকে কীভাবে তৈরি করব, তা নিজেকেই ঠিক করতে হবে। কলেজে শিক্ষকেরা থাকবেন সহায়ক হিসেবে।’
অগ্রজদের অনুসরণ করেই এগিয়ে যেতে চান অনুজেরা। কথা হলো প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অনীক শেখের সঙ্গে। বলছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে ক্যাম্পাস মানে খেলার মাঠ, সাজানো–গোছানো পরিবেশ। এখানে এসে সেটা পেয়েছি। বিশাল এই ক্যাম্পাস মনের বিশালতা বাড়িয়েছে। বড় হওয়ার স্বপ্ন জাগিয়েছে।’
কলেজে ল্যাব–সুবিধা পড়ালেখার মান বাড়িয়েছে বলে মনে করেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আহসান তনভীর। তাঁর ভাষ্য, ‘অনেক কলেজে ল্যাব–সুবিধা নেই। আমাদের একটা সমৃদ্ধ ল্যাব আছে। সেখানে হাতেকলমে শেখা যায়। শিক্ষকেরাও বেশ ভালো। সবাই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ক্লাস করান।’
ইংরেজিতে মাস্টার্স পড়ছেন শান্তি ইসলাম। স্বপ্ন দেখেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেবেন। তিনি বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়েছিলাম। তবে সে হতাশা বেশি দিন থাকেনি। বিশাল ক্যাম্পাস আর শিক্ষকদের আন্তরিকতায় ভালোই কেটেছে দিনগুলো।’
এবার র্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় হলেও সামনের বছর প্রথম হওয়ার প্রত্যাশা কলেজের শিক্ষার্থীদের।
এডওয়ার্ড কলেজের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। এখানে বহু গুণী মানুষের পদধূলি পড়েছে। এখানকার বহু শিক্ষার্থী সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা, রাজনীতি ও চাকরিতে বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। আমরা এই সম্পর্কটাকে আরও উন্নত করতে কাজ করছি। কলেজে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি করার চেষ্টা চলছে। শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞানে যত ভালো বই আছে, যতটা সম্ভব সংগ্রহের চেষ্টা করছি। আমরা এডওয়ার্ড কলেজকে দেশের অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাজাতে চাই। ভয়শূন্য, মুক্তচিন্তার জায়গায় পরিণত করতে চাই। সাজানো–গোছানো একটি ক্যাম্পাস করতে চাই। হলের মান বৃদ্ধি, প্রতিটি হলে মিনি–লাইব্রেরি করতে চাই। চাই, আমাদের ক্যাম্পাস একটা মন ভালো করা জায়গা হোক, যেখানে শিক্ষকেরা মনের আনন্দে পড়াবেন, শিক্ষার্থীরাও আনন্দ নিয়ে পড়বেন। এসব লক্ষ্যেই কাজ চলছে। এবার এডওয়ার্ড কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় হয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে প্রথম হবে।মো. মাহবুব সরফরাজ, অধ্যক্ষ, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ