ছোট ছোট প্লাস্টিকের ব্লকের লেগো সংগ্রহ করা অনেকেরই নেশা। খেলনার মাধ্যমে শিশুদের সৃজনশীলতা ও মানসিক সংযোগের জন্য লেগো জনপ্রিয়। এই বছরে লেগো ব্লকের ৭৫ বছর বয়স হবে। আলোচিত এই বিল্ডিং ব্লক খেলনা শিশু-কিশোরদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও ধৈর্যের প্রমাণে বেশ আলোচিত।
প্রথমে সাধারণ কাঠের খেলনা ব্লক হিসেবে বাজারে আসে এই খেলনা। কয়েক দশক ধরে পুরো বিশ্বজুড়ে নির্মাতা, শিল্পী, স্থপতি থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেছে। ছোট এক ডেনিশ ওয়ার্কশপে যে খেলনার বিকাশ, তা এখন একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড।
লেগোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওলে কার্ক ক্রিশ্চিয়ানসেন নামের এক কাঠমিস্ত্রির নাম। ডেনমার্কের বিলুন্ডের এই মিস্ত্রি ১৯৩২ সাল থেকে কাঠের খেলনা তৈরি শুরু করেন। নানা ধরনের খেলনা তৈরি করে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কাজের দর্শন ছিল, ‘অনলি দ্য বেস্ট ইজ গুড এনাফ’, যার অর্থ সেরাটাই শুধু ভালো। ১৯৩৪ সালে ডেনিশ শব্দ লেগ গড্ট (ভালো খেলুন) থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম লেগো রাখেন কার্ক। ১৯৪৭ সালে প্রথম প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি শুরু করেন তাঁরা। ১৯৪৯ সালে প্রথম জোড়া লাগানোর উপযোগী লেগোর ব্লক তৈরি করে বাজারজাত করা শুরু করেন তাঁরা। যে ব্লকের মাধ্যমে নানা ধরনের বস্তু বা নিদর্শন নির্মাণ করা যায়।
১৯৬০ ও ১৯৭০ দশক সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে লেগো। ডেনমার্কের বাইরেও দেখা যায় লেগোর উন্মাদনা। নকশা করা হয় নানা ধরনের সেট বা ব্লক স্টাইল। এখন লেগো ব্লকে তৈরি করা যাচ্ছে সাধারণ ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে যানবাহন, তাজমহল থেকে স্পেস শাটল বা প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের মতো মডেল, যা কিছু মানুষ কল্পনা করতে পারে, তাই নাকি লেগোতে বানানো সম্ভব। ১৯৭৮ সালে লেগো প্রবর্তন করে মিনিফিগার। ছোটখাটো হলুদ এসব চরিত্র লেগোতে গল্প বলার নতুন একটি দিগন্ত সৃষ্টি করে। শিশুদের নিজস্ব অ্যাডভেঞ্চার গল্প তৈরিতে অনুপ্রাণিত করে। বিভিন্ন চরিত্রের লেগো মিনিফিগার এখন ভীষণ জনপ্রিয়। জানা যায়, এ পর্যন্ত ৪০০ কোটি মিনিফিগার বিক্রি করেছে লেগো, যেখানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটির বেশি।
১৯৯৮ সালে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে লেগো। তৈরি করে মাইন্ডস্ট্রর্মস নামে রোবোটিক কিট। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে লেগো ব্লকের মাধ্যমে রোবট তৈরি করা যায়। লেগোর মাধ্যমে শিশুদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে অনেক। প্রতি মিনিটে প্রায় ৩৬ হাজার ব্লক তৈরি করে লেগো, বছরে তৈরি করে প্রায় ২০ বিলিয়ন ব্লক। ২০৩০ সালের মধ্যে সব পণ্য টেকসই উপকরণ থেকে তৈরি করার জন্য এখন কাজ করছে লেগো। চলছে উদ্ভিদভিত্তিক প্লাস্টিক ব্লক তৈরির গবেষণা। ২০১১ সালে স্পেস শাটল এন্ডেভারের অভিযাত্রীরা ১৩টি লেগো সেট মহাকাশে নিয়ে যায়। লেগো নিয়ে ২০১৪ সালে মুক্তি পায় দ্য লেগো। সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী ৪৬৯ মিলিয়ন ডলায় আয় করে। ইতালির মিলানে ২০১৫ সালে ৩৫ দশমিক শূন্য ৫ মিটার উচ্চতার লেগো টাওয়ার এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে উঁচু লেগো স্তম্ভ বা কাঠামো। এই কাঠামোতে ব্যবহার করা হয় সাড়ে পাঁচ লাখ লেগো ব্লক। ২০১৫ সালে ফেরারি গাড়িকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্র্যান্ডের তকমা পায় লেগো।
লেগোর ৭৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে ‘দ্য ম্যাজিক অব লেগো’ নামে ১০০ পৃষ্ঠার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে টাইম। তারা লিখেছে ‘যে খেলনা পৃথিবী বদলে দিয়েছে।’ কয়েক বছর আগে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ সোরেন এইলার্স জানান, ৪ বাই ২ সাইজের ৬টি ব্লকের চতুর্ভূজ দিয়ে ৯১ কোটির বেশি কাঠামো তৈরি সম্ভব। ২০০০ সালে লেগোকে শতাব্দীর সেরা খেলনার খেতাব দেয় ব্রিটিশ টয় রিটেইলার্স অ্যাসোসিয়েশন। ২০০৮ সালে বাজারে আসে ৫৯২২ লেগো ব্লকের তাজমহলের সেট। ২০২২ সালে বাজারে আসে আইফেল টাওয়ারের লেগো ব্লক। এতে ১০ হাজার ১টি ব্লক আছে। রোমের কলোসিয়াম থেকে শুরু করে হ্যারি পটারের হগওয়ার্টস দুর্গ—সবই তৈরি হয় লেগো ব্লকে। আর বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক ভিত গড়তে এখনো তাই লেগোর ওপরেই আস্থা রাখছেন মা–বাবারা।
সূত্র: টাইম