প্রোগ্রামিংয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সুনাম আছে। কীভাবে এই ক্যাম্পাসে কোডিং–প্রোগ্রামিংয়ের একটা আলাদা সংস্কৃতি গড়ে উঠল? লিখেছেন নোমান মিয়া
শাবিপ্রবিতে প্রোগ্রামিং চর্চার পালে একটা জোর হাওয়া লেগেছিল সম্ভবত ২০১২ সালে। সে বছরই প্রোগ্রামিংজগতের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ইন্টার কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কম্পিটিশনের (আইসিপিসি) ফাইনালে ওঠে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি দল। এরপর আরও আটবার আইসিপিসির ফাইনালে উঠেছেন শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা।
কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান প্রভাষক এ কে এম ফখরুল হোসেন বলছিলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়েই আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মজবুত একটি প্রোগ্রামিং কমিউনিটি কালচার তৈরি হয়েছে। সিনিয়ররা জুনিয়রদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। শিক্ষক আর অ্যালামনাইরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।’
কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল এবং সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের নবীন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম দিন থেকেই এখানে হাতে–কলমে প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা পান। প্রোগ্রামিংয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কথা শিক্ষার্থীদের জানানো হয় নবীনবরণের দিনই, যেন তাঁরাও এই গৌরবের অংশ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। পরদিনই ‘কম্পিটেটিভ প্রোগ্রামিং ল্যাবে’ নবীনদের নিয়ে একটি কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে তাঁরা কিছু মজার সমস্যার সমাধান করেন। প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি তৈরি হয় আগ্রহ ও কৌতূহল। এ ছাড়া প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টার থেকেই ক্লাসে শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি আগ্রহী করেন শিক্ষকেরা।
২০১৫ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনের তিনতলার দুটি ঘর শুধু প্রোগ্রামিং ল্যাব হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ৩৩২ (এ) ও ৩৩২ (বি) কক্ষ দুটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ভেতরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে প্রায় ৪০টি কম্পিউটার। প্রোগ্রামিংয়ের এই ল্যাব দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে।
শিক্ষার্থীরাও কেউ কেউ কাঁথা, বালিশ ও কম্বল নিয়ে হাজির হয়ে যান। দল বেঁধে কাজ করতে করতে কেউ হয়তো চট করে একটু ঘুমও দিয়ে নেন। ঘুম থেকে উঠে আবার চলে কাজ। ল্যাবের ভেতর হোয়াইট বোর্ড আছে। অতএব কেউ যদি দল বেঁধে কাজ করতে চান, হোয়াইট বোর্ডে আঁকিবুঁকি করে সবাই মিলে নতুন কোনো আইডিয়া ঝালাই করতে চান, আছে সেই সুযোগও।
শিক্ষার্থীদের অনেকে প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি এতটাই আগ্রহী যে ঈদ বা গ্রীষ্মকালের ছুটিতেও বাড়ি যেতে চান না। ল্যাবেই পড়ে থাকেন। প্রোগ্রামিংয়ের সমস্যায় ডুবে থাকাতেই তাঁদের আনন্দ। প্রভাষক এ কে এম ফখরুল হোসেন বলছিলেন, ‘অসুস্থতা থাকুক, ঈদের ছুটি থাকুক, তা-ও কেউ কেউ ল্যাবেই থাকে।’
শুধু যে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল কিংবা সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরাই ল্যাবে ভিড় করেন, তা নয়। ইংরেজি, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, পরিসংখ্যান কিংবা রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরাও প্রোগ্রামিংয়ে সক্রিয় অংশ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের কম্পিটেটিভ প্রোগ্রামিং ও ডেভেলপমেন্টের দুটি আলাদা ল্যাব আছে। সেখানেও ২৪ ঘণ্টাই চলে অনুশীলন।
তবে প্রোগ্রামিংয়ের চর্চা পুরোটাই যে ল্যাবকেন্দ্রিক, তা-ও নয়। নিজেদের মতো করেও আলাদা আলাদা দল এখানে প্রোগ্রামিংয়ের চর্চা করে। তারাও শাহজালালের প্রোগ্রামিং কমিউনিটিরই সদস্য।
ল্যাবে ২৪ ঘণ্টাই ক্যাম্পাসের ছোটদের পরামর্শক হিসেবে থাকেন বড়রা। সমস্যা সমাধান, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ—সবই তাঁরা দেখভাল করেন। প্রতি সপ্তাহের শেষে প্রোগ্রামিংয়ের ওপর জুনিয়রদের একটি ক্লাস নেন সিনিয়ররা। এই ক্লাসকে বলা হয় ‘প্রোগ্রামিং ক্যাম্প’। ক্যাম্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিভাগের যেকোনো শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারেন। এখানে প্রোগ্রামিং–সংক্রান্ত নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, পরের সপ্তাহের জন্য কাজও দিয়ে দেন সিনিয়ররা। এভাবেই নিয়মিত চর্চা চলে।
কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী উষান ঘোষ বলেন, ‘ল্যাবে নিজেদের মধ্যে পারসন টু পারসন পর্যায়ে জুনিয়ররা সিনিয়রদের কাছ থেকে শিখতে পারে। কে কতটা দক্ষ, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা বিভিন্ন টাস্ক দিই।’
কথা হলো কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত দাসের সঙ্গে। বললেন, ‘ল্যাবে বছরব্যাপী ক্যাম্প চলে। ছুটির দিনে আমাদের সিনিয়র ভাইয়েরা বিগিনার, ইন্টারমিডিয়েট, অ্যাডভান্স—এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে জুনিয়রদের ক্লাস নেন। এ ছাড়া প্রতিবছর ইন্ট্রা সাস্ট নামের প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রতিযোগিতা ঘিরেও একটা ভালো চর্চা হয়।’
প্রোগ্রামিং কমিউনিটিতে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অ্যালামনাইরা কিছুদিন পরপর ল্যাবে এসে ক্লাস নেন। অনলাইনে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করেন। বিভিন্ন ‘প্রবলেম সেট’ দিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজনও করেন তাঁরা। এ ছাড়া হাতে-কলমে শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি কিংবা বিজয়ীদের সংবর্ধনা দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষকেরাও জড়িয়ে থাকেন ওতপ্রোতভাবে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাগুলোয় ‘শক্তিশালী দল’ হিসেবে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের বেশ পরিচিতি আছে। আইসিপিসিতে আটবার ফাইনালে গেছে শাবিপ্রবির বিভিন্ন দল। এ বছরও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে তৃতীয় হয়ে নবমবারের মতো ফাইনালিস্ট হিসেবে মনোনীত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আগামী সেপ্টেম্বরে কাজাখস্তানে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড ফাইনালে অংশ নেবেন তাঁরা।
আইসিপিসির আঞ্চলিক পর্যায়ে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল। এ ছাড়া আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং ও হ্যাকাথন প্রতিযোগিতাতেও চ্যাম্পিয়নের পুরস্কার এসেছে বেশ কয়েকবার।
সবশেষ গত ১১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের আয়োজনে ‘কোড সামুরাই ২০২৪’ হ্যাকাথন প্রতিযোগিতায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের দল ‘ডিফাইন কোডার্স’ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
একসময় যাঁরা দিন-রাত ক্যাম্পাসে প্রোগ্রামিংয়ে বুঁদ হয়ে থেকেছেন, তাঁদের অনেকেই এখন বিশ্বের নামী টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছেন। গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, ফেসবুক—সব বড় প্রতিষ্ঠানেই আছেন শাবিপ্রবির স্নাতকেরা।
মাইক্রোসফটের লন্ডন কার্যালয়ে কাজ করেন শাবিপ্রবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী কাজী নাঈম। তিনি বলেন, ‘একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে আমি দেখেছি, কীভাবে আমাদের কল্পনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে প্রোগ্রামিং। ৮-১০ বছর আগেও অনেক কিছু শুধু কল্পনায় ছিল, এখন সবাই তা ব্যবহার করছে। আমার যাত্রায় আমি সিনিয়র, সহপাঠী, শিক্ষক, অ্যালামনাই ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে প্রচুর সহায়তা পেয়েছি।’ নবীনদের উদ্দেশে কাজী নাঈমের পরামর্শ, ‘সাহায্য চাইতে এবং অন্যকে সহযোগিতা করতে কখনো দ্বিধা করবে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভুল করতে ভয় পাবে না। প্রতিটি কোডের লাইন অসীম সম্ভাবনার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। মনে রেখো, আজকে যে বিশেষজ্ঞ, সে-ও একদিন শিক্ষানবিশ ছিল। কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও অধ্যবসায় এমন কিছু তৈরি করতে সহায়তা করে, যা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানা উদ্ভাবন শুধু যে কাগজে-কলমে বা কম্পিউটারে আটকে থেকেছে, তা নয়। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নও হয়েছে। বাংলায় দেশের প্রথম সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের তৈরি। মেসেজের মাধ্যমে ভর্তির প্রক্রিয়া এই ক্যাম্পাসেই চালু হয়েছে। সিলেটের নিজস্ব নাগরি ভাষা সংরক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব তথ্য একটি অ্যাপে সংরক্ষণের জন্য চালু হয়েছে ‘মাই সাস্ট’। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী হলে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে ও প্রশাসনিক ভবনে ডিজিটাল হাজিরা পদ্ধতি, পরিবহনে অনলাইন ট্র্যাকিং পদ্ধতি ইত্যাদি উদ্যোগে আছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অবদান।
মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োইনফরমেটিকস, মানুষ ও কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগসহ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছে বলে জানালেন শিক্ষার্থীরা। পানির নিচে চলতে পারে এমন রোবট, স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হওয়ার মতো যানবাহন, ডকুমেন্ট ব্লকচেইন পদ্ধতি ইত্যাদি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বাজেটের সংস্থান হলে এসব উদ্ভাবন আরও উন্নত করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব বলে জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরহাদ রাব্বি। তিনি বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার যেন একটা সংযোগ তৈরি হয়, সে জন্যও আমরা কাজ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করি, তখন বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন। তাঁরা আমাদের পরামর্শ দেন। এ ছাড়া আমাদের সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে ছয় মাসের জন্য শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এতে তাঁদের পেশাগত দক্ষতা গড়ে ওঠে। আমাদের পাঠ্যসূচি তৈরির সময়ও বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রির একজন প্রতিনিধিকে রাখা হয়।’