মডেল: আমিন ও দীপ্তি
মডেল: আমিন ও দীপ্তি

ফ্রেশারদের মধ্যে চাকরিদাতারা কী খোঁজেন

একদিকে তরুণেরা বলেন, শুধু সনদ থাকলেই চাকরি মেলে না। অন্যদিকে চাকরিদাতারা বলেন, তাঁরা যোগ্য লোক পান না। ঘাটতিটা আসলে কোথায়? সদ্য স্নাতকদের মধ্যে চাকরিদাতা বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত কোন কোন দক্ষতা দেখতে চান? চাকরিদাতা, মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বলে তা-ই জানার চেষ্টা করেছেন জাহিদ হোসাইন খান

সৃজনশীলতা এখন সবার আগে

চাকরিদাতা একজন ‘ফ্রেশারের’ মধ্যে সবার আগে সৃজনশীলতা খোঁজেন। বলছিলেন পেট্রোম্যাক্স এলপিজি লিমিটেডের মানবসম্পদ পরিচালক লামিয়া বুশরা। লামিয়া এর আগে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের গ্রুপ মানবসম্পদপ্রধান, ব্র্যাক ব্যাংকের রিক্রুটমেন্ট ও রিলেশনশিপ–প্রধানসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সৃজনশীল কর্মীরা সাধারণত সমস্যার নতুন নতুন সমাধান খুঁজতে পারেন। প্রচলিত চিন্তার বাইরে গিয়ে ভাবতে পারেন, উদ্ভাবনী সমাধান দিতে পারেন। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এমনটাই চায়।’ ২০২৩ সালের ম্যাকিঞ্জ অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৮ ভাগ নিয়োগকর্তা সদ্য স্নাতকদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হিসেবে সমস্যা সমাধান ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে এগিয়ে রাখেন। মনে রাখতে হবে, সৃজনশীলতা শুধু শিল্পকলা বা ডিজাইনের বিষয় নয়। বরং সমস্যার সমাধানে নতুন পদ্ধতি বের করা, দলগত কাজের মধ্যে নতুন ধারা আনা কিংবা বিপণন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নিত্যনতুন চিন্তাধারা যোগ করা—এসবও সৃজনশীলতারই অংশ।

শেখার আগ্রহ থাকতেই হবে

ফ্রেশারদের মধ্যে চাকরিদাতারা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ খোঁজেন, আর তা হলো শেখার আগ্রহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘প্রযুক্তি ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই কাজের ধরন এবং চাহিদাও বদলে যাচ্ছে। কেউ যদি দ্রুত নতুন জিনিস শিখতে ও তা প্রয়োগ করতে পারেন, তিনি প্রতিষ্ঠানের জন্যও অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। নিয়োগকর্তারা সব সময় এমন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করেন, যাঁর মধ্যে নমনীয় মানসিকতা আছে। যে নিয়মিত নিজের দক্ষতাকে আপডেট করে। অনেক সময় ফ্রেশারদের লিংকডইন বা সোশ্যাল মিডিয়ার আচরণ দেখেও তাঁর শেখার আগ্রহ বা মানসিকতা বোঝা যায়। অনলাইনে একজন মানুষ কেমন আচরণ করছেন, চাকরিদাতারা আজকাল সেটাও দেখেন।’

ধৈর্য থাকতেই হবে

করপোরেট সংস্কৃতিতে ‘ধৈর্য’ একজন সদ্য স্নাতকের জন্য খুব জরুরি। চাপের মধ্যে থেকেও সময়মতো কাজ শেষ করতে পারা একটি বড় দক্ষতা। ধৈর্য না থাকলে আপনি এই দক্ষতা রপ্ত করতে পারবেন না। কঠিন সময়েও ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখতে হবে। অনেক সময় কাজ শেষ করতে সময় লাগতে পারে বা প্রত্যাশিত ফল না-ও আসতে পারে। এই অবস্থায় ধৈর্য ধরে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা থাকা জরুরি। ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির (ইবিএল) মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘চাকরিদাতারা এমন কর্মী চান, যাঁরা আবেগকে সংযত করতে পারেন। কর্মক্ষেত্রের নেতিবাচক পরিস্থিতিকে ইতিবাচকভাবে সামলাতে পারেন। ফ্রেশারদের ক্ষেত্রে মানসিক স্থিরতা ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ।’ বিজনেস ইনসাইডারের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৭১ শতাংশ নিয়োগকারী ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে মানসিক বুদ্ধিমত্তাকে অগ্রাধিকার দেন। এ ছাড়াও দলের মধ্যে গতিশীলতা ও নেতৃত্বের সম্ভাবনার ওপর জোর দেন অনেকে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সময় আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা, সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, পাশাপাশি ইতিবাচক কর্মপরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রেও আবেগপ্রবণ বুদ্ধিমত্তা (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স) আবশ্যক।

নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আগ্রহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান

সব চাকরিতেই নানা চ্যালেঞ্জ থাকে। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মনোভাব থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডেলয়েটের একটি প্রতিবেদন বলছে, ৬৪ শতাংশ নিয়োগকর্তা কাজের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাকে বেশি গুরুত্ব দেন। মূলত মহামারি–পরবর্তী সময়ে এই দক্ষতার চাহিদা বেড়েছে। কানাডার সেন্টেনিয়াল কলেজের এইচআর বিজনেস ফ্যাকাল্টি ও রবি আজিয়াটা লিমিটেডের সাবেক প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফয়সাল ইমতিয়াজ খান বলেন, ‘যাঁরা নতুন দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, কাজের নতুন ক্ষেত্রে নিজেদের পরীক্ষা করতে চান, চাকরিদাতারা তাঁদেরই খোঁজেন। কারণ, এর মাধ্যমে একদিকে কর্মীর ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নতি হয়, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানেরও লাভ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানও কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে টেকনিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, আইটি, এ ধরনের খাতে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের প্রয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বইয়ের জ্ঞান আর প্রায়োগিক জ্ঞানের মধ্যে কখনো কখনো অনেক ফারাক থাকে। তারপরও বেসিকটা ঠিক থাকলে একজন ফ্রেশার অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধা পাবেন।’

সহশিক্ষা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা

একজন চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি আছে কি না, সেটা স্রেফ এক সাক্ষাৎকারে যাচাই করা খুব কঠিন। তাই নেতৃত্ব, দলের সঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা—এসব যাচাইয়ের জন্য চাকরিদাতারা জানতে চান, সহশিক্ষা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা আছে কি না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক রিয়েল স্টেট প্রতিষ্ঠান জোনস ল্যাং লাসালের জ্যেষ্ঠ পরিচালক এ এইচ এম সাইফ হোসেন বলেন, ‘৪০-৫০ মিনিটের ইন্টারভিউতে একজন প্রার্থীর সবকিছু বোঝা যায় না। তাই যোগাযোগের দক্ষতার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়। করপোরেট সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব এবং দলগত সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ ধরনের অভিজ্ঞতা ফ্রেশারদের খুব কাজে লাগে। চাকরিদাতারা সব সময়ই এমন কর্মী চান, যাঁরা সঠিকভাবে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবে। দলগত কাজে অবদান রাখতে পারবে। শুধু ইংরেজিতে ভালো কথা বলতে পারা মানেই কিন্তু যোগাযোগের দক্ষতা নয়। নিজের মাতৃভাষায় সে কতটা সাবলীল, ভাবনাটা কত ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারছে, এসবও যাচাইয়ের বিষয়।’

প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও সময় ব্যবস্থাপনা

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের এক গবেষণায় বলা হয়, ৭৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান দক্ষতাভিত্তিক নিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। ফয়সাল ইমতিয়াজ বলেন, ‘আজকের ডিজিটাল যুগে চাকরিদাতারা ফ্রেশারদের মধ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা খোঁজেন। মাইক্রোসফট অফিস থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিং, ডেটা অ্যানালিটিকস, ডিজিটাল মার্কেটিং, ইত্যাদি বিষয়ে যত ভালো দখল থাকবে, আপনি তত এগিয়ে থাকবেন। বিশেষ করে আইটি খাতে কাজ করতে হলে নির্দিষ্ট সফটওয়্যার ও বিভিন্ন টুলস ব্যবহারের দক্ষতা আশা করে। ফ্রেশারদের মধ্যে সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতাও একটি বড় গুণ। সময় মেনে চলতে পারছেন মানে আপনি কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস। এই সিরিয়াসনেসটাই অনেকে দেখতে চান।’