মা–বাবার বয়স হলে তাঁদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করুন। মডেল: রওনক হোসেন, শুভ ও উল্কা হোসেন
মা–বাবার বয়স হলে তাঁদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করুন। মডেল: রওনক হোসেন, শুভ ও উল্কা হোসেন

বয়স্ক মা–বাবাকে সময় দিচ্ছেন তো

ফেসবুকে একটা ভাইরাল মিম নিউজ ফিডে ঘুরছে। সেখানে দুটি ছবি ওপর-নিচে কোলাজ করা। ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুটি শিশু মাকে দুই হাত দিয়ে ধরে নিজের দিকে টানছে আর বলছে, ‘আমার মা, আমার মা।’ দ্বিতীয় ছবিতে সেই মা বৃদ্ধ হয়েছেন, ছেলেরা বড় হয়েছেন, এবার সেই দুই ছেলেই মাকে দুজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘তোর মা, তোর মা।’ অনেকেই মিমটা শেয়ার করে লিখছেন, এটা অনেক পরিবারের বাস্তব চিত্র। যখন সন্তানদের মাকে প্রয়োজন, তখন তাঁরা মাকে ধরে টানাটানি করছেন। আর পড়ন্ত বিকেলে যখন মায়ের সন্তানদের প্রয়োজন, তখন সন্তানেরা মাকে অপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অথচ পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গেই সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসার তুলনা হয় না। সন্তানের দায়িত্ব, বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবার দেখভাল করা, তাঁদের শেষবেলায় নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে পাশে থাকা। শীত এলে সেটা আরও বিশেষভাবে খেয়াল রাখা জরুরি।

মা–বাবাকে কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে। রওনক হোসেন, উল্কা হোসেন ও শুভ

অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী বললেন, শীতে নানা রকম ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। বয়সীদের মধ্যে যাঁরা ক্রনিক রোগে, যেমন ডায়াবেটিস বা আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত, পরিবারের কেয়ারগিভারদের তাঁদের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। ফুল বডি চেকআপ করাতে পারলে সবচেয়ে ভালো। শীতকালে সুগার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। খুব ভোরে বা সূর্য ডোবার পর বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই। রোদে বের হতে পারেন। মোজা, কানটুপি, স্কার্ফ ব্যবহার করে নিজেকে উষ্ণ রাখতে হবে। খাবারে তেল-মসলা যতটা পারা যায় কমাতে হবে।

কঠোরতা নয়, ভালোবাসা

ডিসেম্বরের ছুটিতে পরিবারের অনেক সদস্য একসঙ্গে হবেন। তখন হঠাৎ হয়তো আপনার বয়সী মা-বাবার এমন কিছু লক্ষণ দেখলেন যে আপনার ভ্রু কুঁচকে গেল। ভাবছেন, বাবাকে এত দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে কেন? মা এভাবে হাঁটছেন কেন, তিনি কি পড়ে গিয়ে কোথাও আঘাত পেয়েছেন? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর আর মনের পরিবর্তন স্বাভাবিক। ষাটোর্ধ্বদের উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিসের মতো অসুখগুলো চেপে বসা যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে শারীরিক কর্মক্ষমতা হ্রাস, হাঁটাচলার সমস্যার সঙ্গে হুটহাট আঘাত পাওয়ার ঘটনাগুলোও বাড়তে থাকে। লাঠি, ওয়াকার, কমোড, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার বিশেষ চেয়ার ছাড়াও আপনাকে যেন মা-বাবা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অবলম্বন হিসেবে কাছে পান।

বয়স্ক মা–বাবাকে আপনি চা বানিয়ে খাওয়াতে পারেন

বার্ধক্যে শরীরের মতো মস্তিষ্কও ধীরগতির হয়ে আসে। দেখা দেয় ডিমেনশিয়ার মতো অসুখ। অনেক সময় এই বয়সে তাঁরা চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু অনেক কথা বলতে চান। তাই যা মনে আসে, বলে ফেলেন। এ কারণে কথাবার্তা দিয়ে তাঁদের সে সময় ‘বিচার’ করা মোটেও ঠিক নয়। আদতে মা-বাবাকে কখনোই ‘কাঠগড়ায়’ দাঁড় করানো ঠিক নয়; বরং ভালোবাসা দিয়ে তাঁদের মনের ক্ষত মুছে দিন।

যেসব লক্ষণ দেখে সচেতন হবেন

নিয়মিত চোখের সামনে থাকলে অনেক সময় মা-বাবার বৃদ্ধ হয়ে যাওয়াটা আমরা সেভাবে বুঝতে পারি না। তাই কিছু লক্ষণ দেখলেই সেটাকে বিপদচিহ্ন হিসেবে ধরে নিতে হবে—

১. চলাফেরায় ভারসাম্য হারালে, বারবার
পড়ে গেলে।

২. গাড়ি চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে।

৩. হঠাৎ নাটকীয়ভাবে ওজন কমতে থাকলে।

৪. বিষণ্নতা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, মৃত্যুচিন্তা, ক্ষুধামান্দ্য, এমনকি হ্যালুসিনেশন দেখা দিলে।

৫. কোনো কিছুতেই আগ্রহ না পেলে।

৬. সব সময় সবাইকে সন্দেহ করলে। এ সময় মনে ভয় ঢুকে যায় যে আশপাশের সবাই বুঝি ক্ষতি করতে চাইছেন, মনে মনে তাঁর বিরুদ্ধে দুরভিসন্ধি আঁটছেন।

৭. মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলে, হুট করে রেগে গেলে।

৮. ভুলে যাওয়া, ওষুধ ঠিকমতো খেতে না পারা, টাকাপয়সার হিসাব গুলিয়ে ফেলা, সহজেই প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া, বারবার একই কথা বলতে থাকা ইত্যাদি।

মা যেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অবলম্বন হিসেবে বৃদ্ধ বয়সে আপনাকে কাছে পান। মডেল: শুভ ও উল্কা হোসেন

কেন এমন হয়

  • বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কসহ শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যকারিতা হারাতে থাকে।

  • সামাজিক বা পারিবারিক জীবন যাপন না করা। একাকিত্ব থেকে দুশ্চিন্তার শুরু। দুশ্চিন্তা ডেকে আনে অসংখ্য শারীরিক ও মানসিক অসুখ।

  • অবজ্ঞা ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণেও নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। অনেকেই প্রিয়জন হারানোর ধাক্কা, সন্তান বা জীবনসঙ্গীর মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠতে পারেন না। সেটা ভেতরে–ভেতরে মারাত্মক ক্ষতি করে।

  • কর্মজীবী মানুষ বেকার হয়ে গেলে, কাজের মধ্যে না থাকার ফলে নানা জটিলতা তৈরি হয়। এ কারণে অনেকেই অবসরের পর হঠাৎ স্ট্রোক করেন।

  এসব লক্ষণ দেখলে কী করবেন

  • প্রথমত, বয়স হয়ে গেলেও যতটা সম্ভব কাজের মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে। জাপানিদের দীর্ঘ সময় সুস্থ থাকার অন্যতম কারণ হলো কর্মক্ষম জীবনযাপন।

  • বয়সী মা-বাবাকে সময় দিন। অফিস থেকে ফিরে চা নিয়ে গল্প করুন। একসঙ্গে টিভি দেখুন। সারা দিনে অফিসে কী ঘটল, বলুন। সারা দিন বাসায় কী হলো, শুনুন।

  • মা-বাবাকে আপনার সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে দিন।

  • মা-বাবাকে সংসারের কিছু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিন। যেমন গাছের যত্ন নেওয়া বা কিছু বাজার করতে দেওয়া অথবা আপনার সন্তানদের হোমওয়ার্ক করানো, কোনো বিশেষ রান্না ইত্যাদি।

  • তাঁদের ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ান। ছুটির দিনে ঘুরতে নিয়ে যান, বাইরে খেতে যেতে পারেন।

  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ সময়ে তাঁদের কোনো কর্মকাণ্ড বা কথা নিয়ে হইচই না করে ধৈর্য ধরে তাঁদের মনের অবস্থা বুঝুন। তাঁদের মনে কষ্ট দিয়ে কথা না বলা। কোনো অবস্থাতেই অবহেলা না করা। তাঁদের ঠিকমতো সময় দিন।

  • সম্ভব হলে সকালে বা বিকেলে মা-বাবাকে নিয়ে হাঁটতে যান। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত নিন। তাঁদের বোঝান, তাঁরা কী জন্য গুরুত্বপূর্ণ।