কেমন আলো ঘুমের ঘরে

আমাদের আবহাওয়ায় কতটুকু উপযোগী, এসব বিচার–বিবেচনা না করেই অনেক সময় আমরা পশ্চিমা অনুকরণে বাড়ির নকশা করি। বাড়ির আলোকসজ্জার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। এ অঞ্চলের মানুষের শোবার ঘরের আলোকসজ্জা কেমন হওয়া উচিত, জানাচ্ছেন সাইফুর রহমান

শোবার ঘরের আলো মৃদু রাখাই ভালো

বিয়ের পর মগবাজারের দিলু রোডে দুই রুমের একটা বাসা নিয়েছিলাম আমরা। মূলত দুটি বারান্দার কারণেই বাড়িটা আরও বেশি পছন্দ হয়েছিল। ঢাকা শহরের বাসায় এখন তো ঠিকঠাক একটা বারান্দাই খুঁজে পাওয়া দায়। মাস্টার বেডরুমের একটা পাশে গ্লাস লাগানো, ওপাশেই বড় বারান্দা।

কিছুদিনের মধ্যেই নকশার গলদ হাতে-কলমে টের পেলাম। শোবার ঘরে প্রচুর আলো ঢোকে। একই উৎস শব্দদূষণেরও কারণ। আরেকটা বেডরুম, ড্রয়িং আর ডাইনিং থাকায় আমরা সাধারণত এ ঘরকে ঘুম ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতাম না। সেই বিশাল আলোর উৎস ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে থাকল। এরপর কাঁঠালবাগানে যে বাসায় উঠলাম, সেখানেও মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে গ্লাস দিয়ে আলাদা করা বারান্দা। আলো ঠেকাতে দুই বাসাতেই আমরা ভারী পর্দা ব্যবহার করেছি।

আসলে এ ধরনের নকশা পশ্চিমা শীতপ্রধান দেশের উপযোগী, আমাদের উষ্ণমণ্ডলীয় দেশের জন্য সেভাবে কার্যকর নয়। পশ্চিমা অনুকরণে বাড়ির নকশা আমাদের আবহাওয়ায় কতটুকু উপযোগী, সেটি যাচাই না করেই এ অঞ্চলের ফ্ল্যাটের জন্য সেই আদল ব্যবহার করা হয়েছে। তাই শোবার ঘরে আলোর বড় উৎস রাখা হয়েছে। সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহারকারীকে পরে ভারী পর্দা ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্লট বিবেচনায় যেদিকে আলো ঢোকার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম, শোবার ঘরটা সেদিকে ফেলাই সমীচীন। আর আলো–বাতাস চলাচলের জন্য একটা জানালাই যথেষ্ট।

শোবার ঘর আমাদের বাসা বা বাড়ির সবচেয়ে ব্যক্তিগত জায়গা। নিরাপত্তার খাতিরেও শোবার ঘরের জানালা যেন সরাসরি মাথার কাছে না হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। শোবার ঘরে খুব উজ্জ্বল বাতির প্রয়োজন নেই। এখানে একটু নরম আলো ব্যবহার করা উচিত। অনেকের ডিম লাইটে ঘুমানোর অভ্যাস।  ফাউন্ড্রিও ডিজাইন অ্যান্ড কনসালট্যান্টের স্থপতি মুনিম হোসেন সাজিদ মনে করেন, সাধারণভাবে একটি মাঝারি আকৃতির শোবার ঘরের জন্য ৫০ থেকে ৬০ ওয়াটের এলইডি বাতি মানানসই। আর বেডসাইডের জন্য ২০ ওয়াটের বাতিই যথেষ্ট। বাতির সুইচ শোবার পর হাতের নাগালে বা রিমোট কন্ট্রোল হলে একবার শুয়ে পড়ার পর আর বাতি নেভানোর জন্য উঠতে হবে না।

শোবার ঘরে পড়াশোনার জন্য টেবিল ল্যাম্পের আলো ভালো

মনোবিদ ও আলোকবিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুমের সময় কোনো আলো না জ্বালিয়ে ঘুমানোই ভালো। সে ক্ষেত্রে সিলিংয়ে সারফেস লাইট, কনসিল লাইট, ফলস সিলিংয়ে পকেট লাইট দিতে পারেন, যা পরোক্ষভাবে ঘরকে আলোকিত করে। আবার ডিমার কন্ট্রোল লাইটিংও করা যেতে পারে। অন্য কাজের সময় আপনি হয়তো ঔজ্জল্য বাড়িয়ে নিলেন, বাকি সময় কমিয়ে রাখলেন।

যদিও শোবার ঘরকে অন্য সবকিছু থেকে আলাদা করে কেবল ঘুমানোর কাজে ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো।

বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সামলাতে নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে একই ঘর। শোবার ঘর অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব ওয়ার্ক স্টেশন হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। আমার ব্যাচেলর জীবনে হলের রুম ছিল কয়েকজনের ঘুম ও পড়াশোনার জায়গা, যেখানে সবাই নিজের স্পেসটুকুতে পড়ার টেবিল, বিছানা আর ব্যক্তিগত ডেস্কটপের একটা সেটিং করেছিল। সবারই ছিল নিজস্ব লাইটিং সিস্টেম। কারোর তাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি।

যেকোনো স্পেস বা জায়গার আলোকসজ্জার নকশা নির্ভর করে ওই জায়গার গঠন বা ব্যবহারের ওপর। নানা কাজের জন্য ব্যবহার করতে হয় কয়েক ধরনের আলো। ধরুন, শোবার ঘরটাই হতে পারে পড়ার ঘর। সে ক্ষেত্রে পড়ার টেবিল জানালার পাশে ফেললে দিনে প্রাকৃতিক আলোতেই কাজ চলবে। আর রাতে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন। তাহলে আপনি রাত জেগে পড়লেও আলোর জন্য আরেকজনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না। শুয়ে বই পড়ার অভ্যাস থাকলে ব্যবহার করতে পারেন ফ্লোরস্ট্যান্ড ল্যাম্প।

সাজসজ্জার কাজটা অনেকে শোবার ঘরেই সারেন। সে ক্ষেত্রে ড্রেসিং ইউনিটের আলোকব্যবস্থা এমনভাবে হবে, যাতে আলো সরাসরি মুখ ও শরীরে এসে পড়ে। আধুনিক ড্রেসিং টেবিল বা ভ্যানিটিতে আলোর ব্যবস্থা থাকে। সেই আলো স্বাভাবিক সাদা আলো। কেননা সাজসজ্জার ক্ষেত্রে আপনি দিনের আলোর মতো নিজেকে স্বাভাবিক আলোতেই দেখতে চাইবেন।

শোবার ঘরের আকার বা সাইজের ওপর নির্ভর করে ওই স্পেসে কী কী আসবাব সাজানো হবে আর কেমন হবে তার আলোকসজ্জা। তবে ঘুমঘরে যেগুলো একান্তই প্রয়োজন, কেবল সেসব আসবাবই রাখা উচিত। নিটল–নিলয় গ্রুপের স্থপতি এইচ এম ফাহিম ফয়সাল আহমেদ সহমত প্রকাশ করে বলেন, ‘নাগরিক জীবনে কাজ শেষে যানজট ঠেলে ঘরে ঢুকে এমনিতেই আমাদের পরিবারকে দেওয়ার মতো সময় হাতে থাকে না। ঘুমের ঘরে কোনো এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়া, যেমন টেলিভিশন, মুঠোফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ থাকা উচিত নয়। এগুলো পরিবারের সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর পথে প্রতিবন্ধক। শোবার ঘরে ঢোকার পর সময়টা যেন একান্তই নিজের আর পরিবারের জন্য হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে।’

বিছানার অবস্থান হওয়া উচিত এমন, যেন শোয়া বা বিশ্রামের সময় তা আপনাকে সবচেয়ে নিরাপদ বোধ দেবে। এ জন্য বেডের অবস্থান হবে এমন যেন শোয়ার সময় আপনার মাথার পেছনে দেয়াল বা কোনো প্রতিবন্ধক থাকে। জানালা থেকে বিছানা যেন নিরাপদ দূরত্বে থাকে। বিছানার পরে উপযুক্ত চলাচলের জায়গা রেখে অন্যান্য আসবাব সাজাতে হবে। এরপর আসবাবের মতোই আলোও যেটুকু না হলেই নয়, সেটুকুর ব্যবস্থা করতে হবে।

বিছানার কাছেই তীব্র আলোর উৎস থাকা সমীচীন নয়। যদি জানালা থাকে, তবে পর্দার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করুন। বাতাস চলাচলের ব্যাপারটাও অবশ্য মাথায় রাখতে হবে। বিছানাসংলগ্ন কৃত্রিম আলোর ক্ষেত্রে মৃদু আলো ব্যবহার করা উচিত। আর আলোর রং হালকা হলুদ, নীলচে বা সবুজাভ হলে ভালো। এতে শোবার ঘরের পরিবেশ শান্তিদায়ক মনে হবে। ওয়ার্কস্পেসে পড়ার টেবিল বা কম্পিউটার টেবিল যদি সহাবস্থান করে, তবে ওই স্থানে উপযুক্ত ডাউন লাইট বা স্পটলাইট ব্যবহার করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আলোর এলাকা যেন ওয়ার্কস্পেস ডিঙিয়ে বিছানাসংলগ্ন এলাকায় অনুপ্রবেশ না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বসতে প্রকাশিত