একটু দূর থেকেই কানে আসছিল গানের আওয়াজ। হলের কাছাকাছি পৌঁছে শিল্পীদের সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল। প্রান্তি, বর্ণা, সুপর্ণা, অদিতি, জাকিয়া, মুনাদের আড্ডায় কে যে মূল গায়ক, বলা মুশকিল। ক্লাসের ফাঁকে অবসরে আড্ডা দিচ্ছিলেন সবাই। মাঝে গিটার হাতে হাজির একজন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল গান। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর শামসেন নাহার খান হলের ছাত্রীদের কাছে এই দৃশ্য খুব চেনা।
পরিবার থেকে দূরে, অচেনা পরিবেশে এসে হলের এই শিক্ষার্থীরা নিজেরা মিলে গড়ে তুলেছে আরেক পরিবার। ক্লাসরুমের লেকচার কিংবা পাঠ্যবই যতখানি শেখায়, হলজীবনও নিশ্চয়ই তার চেয়ে কম শেখায় না। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রেহনুমা রাহীম যেমন বলছিলেন, ‘জীবনের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী আমাদের এই শামসেন নাহার খান হল। সারা দিন ক্লাস-ল্যাবের পর এখানে এসে একটু শান্তি পাওয়া যায়। অনেকটা পাখিদের ঘরে ফেরার মতো।’
হলজীবনে একঘেয়েমি পেয়ে বসার সুযোগ খুব একটা নেই। প্রতিদিনের আড্ডা তো আছেই। সেই সঙ্গে হলের মাসিক ভোজ (ফিস্ট), বিভিন্ন উৎসব থেকে শুরু করে মুড়ি পার্টি—এই ধরনের আয়োজনগুলোও সময়টা উপভোগ্য করে তোলে। তবে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোহনা দে জানালেন এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি ‘মন ভালো করা’ উপাদানের কথা। ‘চুয়েটের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় আমার কাছে প্রকৃতি। প্রতিটি ঋতুই এখানে স্পষ্ট প্রভাব ফেলে। যেমন ঝুম বৃষ্টির দিনে হয়তো দেখা যায় হলে সবাই মিলে বৃষ্টিতে ভিজে উল্লাস করছে। কিংবা কেউ হয়তো একা একাই চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি-বৃষ্টি ঘ্রাণের মধ্যেই ভুনা খিচুড়ির আয়োজন আনন্দটা আরও বাড়িয়ে দেয়। এসব ব্যাপার হয়তো খুব সাধারণ, কিন্তু এই মুহূর্ত আর মানুষেরাই মনে একটা আলাদা জায়গা করে নেয়। কত যে গল্প লুকিয়ে আছে শামসেন নাহার হলের প্রতিটি কোনায়!’
রাত যখন গভীর হয়, দেখা যায় হলের বিভিন্ন করিডরে কেউ কেউ আড্ডায় মগ্ন, কেউ মুঠোফোনে ব্যস্ত, কেউবা পড়াশোনায়। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো হুমায়রা মেহজাবীন বলছিলেন, ‘এই হল ছিল আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি। হলের সবকিছুর মধ্যেই একটা আপন-আপন ভাব থাকে।’
সবুজ নিসর্গের ক্যাম্পাস চুয়েটে পা রাখলেই এখন চোখে পড়ে নতুন নতুন স্থাপনা। এসবের মধ্যে সহজেই নজর কাড়ে লাল ইটে তৈরি একমাত্র আবাসিক হল—শামসেন নাহার খান হল। হলের ভেতরেও রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। ভেতরে-বাইরে বসার ব্যবস্থা তো আছেই, তবে সিঁড়িটিই ছাত্রীদের পছন্দের আড্ডার জায়গা।
২০১৫ সালে তৎকালীন উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম ও বর্তমান উপাচার্য মোহাম্মদ রফিকুল আলম ছাত্রীদের আবাসন-সংকট নিরসনে একটি হল তৈরির উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে শুরু হয় নির্মাণকাজ। প্রায় ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন হলের অর্থায়ন করেছে এ কে খান ফাউন্ডেশন। এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাশেম খানের স্ত্রী শামসেন নাহার খানের নামেই হলের নাম রাখা হয়েছে। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান হলটি উদ্বোধন করেন। নকশা করেছেন চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক স্থপতি সজীব পাল এবং স্থাপত্য বিভাগের প্রভাষক স্থপতি বিপ্লবকান্তি বিশ্বাস।
চুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র ও এ কে খান ফাউন্ডেশনের সহকারী সাধারণ ব্যবস্থাপক রেজাউর রহমান বলেন, ‘এই হলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, চুয়েটের অন্য কোনো হলে যা নেই। বেজমেন্টসহ হলটি ছয়তলা। বেজমেন্টে আছে ছাত্রীদের রান্নাঘর, ডাইনিং রুম, ক্যানটিন, বাথরুম, কমন রুম ও টিভি রুম। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে ওয়েটিং রুম, প্রভোস্ট অফিস, এ কে খান গ্যালারি। লাইব্রেরি, নামাজের ঘর, খেলাধুলার জায়গা—সবই আছে এই হলে।’
আগে একটি মাত্র ছাত্রী হল থাকায় অনেক ছাত্রীকেই থাকতে হতো গণরুমে। শামসেন নাহার হল উদ্বোধন হওয়ার পর ছাত্রীরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। প্রাক্তন ছাত্রী রাইসা তাবাসসুম বলছিলেন, ‘দীর্ঘ ৩ বছর গণরুমে থাকার পর শামসেন নাহার খান হলে ওঠাটা আমাদের কাছে ছিল একদম স্বপ্নপূরণের মতো। নতুন হলে গিয়ে যে সময়গুলো পার করে এসেছি, তার সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না। হলের মাঝখানের অংশটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। বৃষ্টিতে ভেজা থেকে শুরু করে মধ্যরাতের গান—সবকিছুর সাক্ষী ওই জায়গা!’