ঘরসংসার সামলে সমানতালে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন চা-জনগোষ্ঠীর এই সন্তান

এসএসসি পাস করার পরই জবা রানী চাষার বিয়ে হয়ে যায়। বাল্যবিবাহ। তারপরও ঘরসংসার সামলে সমানতালে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন চা-জনগোষ্ঠীর এই সন্তান। এখন জুড়ীর সাগরনাল উচ্চবিদ্যালয়ের তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক। জবার হার না মানার গল্প শোনাচ্ছেন কল্যাণ প্রসূন

জুড়ীর সাগরনাল উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক জবা রানী চাষা

কুলাউড়ার গাজীপুর চা-বাগানে জবা রানী চাষাদের বাড়ি। বাবা নিতাই চাষা ছিলেন চা-বাগানের করণিক। বাড়ির কাছের গাজীপুর চা-বাগান প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে কুলাউড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন জবা। ১৯৯৭ সালে এই স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। এরপর কুলাউড়ার ইয়াকুব-তাজুল মহিলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিক।

বাড়ি থেকে গিয়ে নিয়মিত ক্লাস করেন। পড়াশোনাতেও মনোযোগী। স্কুলের বন্ধুদের পাশাপাশি নতুন নতুন সহপাঠী। সব মিলিয়ে কলেজে আনন্দেই কাটছিল জবার দিন। ঠিক এ সময় আসে বিয়ের সম্বন্ধ। জবা বলেন, ‘কল্পনাতেই ছিল না এ সময় আমার বিয়ে হবে। আমাদের পরিবারের সঙ্গে আগে থেকেই শ্বশুরের চেনাজানা ছিল। জুড়ীর সাগরনাল বাগানের শ্রমিকদের সর্দার ছিলেন তিনি। একবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে বললেন, ছেলের বউ করে নেবেন আমাকে। মা-বাবাও রাজি হয়ে গেলেন।’

জবা তখন কী বলবেন, কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে যাচ্ছিলেন, ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখছিলেন, সেই স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট নিয়েই মা-বাবার ইচ্ছায় বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। তবে শর্ত দিলেন, তাঁকে পড়তে দিতে হবে। জবার বাবার মাধ্যমে শর্ত পৌঁছে গেল বরপক্ষের কাছে। সেই পক্ষও রাজি হলো।

জবা রানী চাষা

এখন আর লেখাপড়ার দরকার কী?

বিয়ের পরই বিরূপ এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো। বই-খাতা নিয়ে কলেজে যান জবা, বন্ধুদের আড্ডায় বসেন, পরিচিত-অল্প পরিচিত মানুষের গৎবাঁধা প্রশ্নটা তীরের মতো এসে বেঁধে তাঁর মনে—তোমার তো বিয়ে হয়ে গেছে, এখন আর লেখাপড়ার দরকার কী?

কষ্ট পেতেন জবা, তবে সেটি মনের মধ্যে জায়গা দিতেন না। এরপর মানুষের এসব কথা কানেও তুলতেন না। পরের কথা না হয় কানে তোলেননি; কিন্তু ঘরের মানুষ! তাদের কথা অগ্রাহ্য করলেন কী করে! কারণ, বিয়ের পরই জবাকে দুবাই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রবাসী স্বামী বাবুল চাষা। রাজি হননি জবা; কিন্তু মুখ ফুটে নিজের সিদ্ধান্ত জানানো সহজ ছিল না।

জবার স্মৃতিতে সেই ঘটনা এখনো স্পষ্ট, ‘বিয়ের তিন-চার মাস পর উনি (স্বামী) আমাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। লেখাপড়া আর করতে পারব না বুঝেই না করে দিই। এরপর নানাভাবে চাপাচাপি শুরু করলেন। শ্বশুর-শাশুড়িকে দিয়েও চাপ দিলেন। আমি রাজিই হলাম না। আসলে আমি পড়াশোনাই করতে চেয়েছিলাম।’

তখন অবশ্য জবার সিদ্ধান্তে সবাই তাঁর ওপর খুব রাগ করেছিলেন। তবে সেই রাগ বেশি দিন থাকেনি। জবার ভাষায় ‘একপর্যায়ে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল।’

সংসার–সন্তান সামলে পড়াশোনা, চাকরি

সবার সহযোগিতায় সংসার সামলে চলতে থাকে জবার পড়াশোনা। ১৯৯৯ সালে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠানে স্নাতকে ভর্তি হলেন। দুই বছর পর জন্ম নেয় তাঁদের বড় সন্তান জয়ন্ত। একদিকে নবজাতকের যত্ন, অন্যদিকে পড়াশোনা। খুব কষ্ট। কিন্তু এত দূর এসে হাল ছাড়ার পাত্রী তো তিনি নন। কলেজে নিয়মিত ক্লাস করা সম্ভব হতো না। এক-দুই সপ্তাহ পরপর কলেজে যেতেন। এভাবেই ২০০২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতক করেন।

চা-বাগানের পাশেই সাগরনাল উচ্চবিদ্যালয়। ২০০৪ সালে পত্রিকায় ওই প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। আবেদন করেন জবা। নিয়োগ পরীক্ষার পর চাকরিটা হয়েও যায়। শুরু হয় তাঁর শিক্ষকতার জীবন। পাশাপাশি পড়াশোনাও এগিয়ে নেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড করেন তিনি। সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ থেকে ২০১৪ সালে স্নাতকোত্তরও করেন। এর মধ্যে তাঁর কোলে আসে যমজ সন্তান অনির্বাণ ও অর্চিতা। সন্তান, সংসার, চাকরি—সবকিছু সামলেই এগিয়ে গেছেন জবা।

সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড কোর্স লাগে। ফের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এই কোর্স সম্পন্ন করেন। জবা জানান, সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও ইংরেজি পড়ান তিনি। ইংরেজি বিষয়ে ব্র্যাক, নায়েমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।

গত জুনে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন জবা। তাতে কয়েকজন প্রতিযোগী অংশ নেন। জবা প্রথম স্থান অর্জন করে এই পদে যোগ দিয়েছেন।

প্রতিষ্ঠান আর পরিবারের পেছনে সময় দিয়েও নিজের সম্প্রদায় নিয়ে ভাবেন জবা

চা-বাগানে বাল্যবিবাহ রোধে জবার উদ্যোগ

জবার স্বামী বাবুল চাষা প্রায় ২৮ বছর দুবাইয়ে প্রবাসজীবন কাটিয়ে ২০১৭ সালে দেশে ফিরে আসেন। তাঁদের বড় ছেলে জয়ন্ত চাষা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানে স্নাতক পড়ছেন। ছোট দুজন সাগরনাল উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী। প্রতিষ্ঠান আর পরিবারের পেছনে সময় দিয়েও নিজের সম্প্রদায় নিয়ে ভাবেন জবা। চা-বাগানের শ্রমিকদের ঘরে-ঘরে ঢুঁ মারেন, স্কুলশিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নেন তিনি। চা-বাগানের শ্রমিকেরা অভাব-অনটনে থাকেন। কেউ কেউ ভালো পাত্র পেলে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান। জবা বাল্যবিবাহের খবর পেলে তাঁদের পড়াশোনার গুরুত্বের কথা বোঝান। অনেকে বুঝতে পেরে সিদ্ধান্ত থেকে সরেও আসেন।

‘চা-বাগানে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হওয়া একসময় রীতি ছিল। তবে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের কারণে এখন সেটি অনেকটা কমে এসেছে’—কথাটা বলার সময় জবা রানী চাষার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।