কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যার ওপারে নিজেদের থাকার জন্য একটি খামারবাড়ি গড়েছে রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খানের পরিবার।
সড়কপথে যাঁরা ঢাকা–ময়মনসিংহে যাতায়াত করেন, তাঁরাই জানেন গাজীপুর চৌরাস্তা পেরোনোর পরই কী একটা শান্তি শান্তি ভাব। আর রাজেন্দ্রপুর মোড় থেকে একটু এগিয়ে ইউটার্ন নিয়ে বাঁয়ে ঢুকলে প্রকৃতির শীতল পরশে তো শরীর–মনই জুড়িয়ে যায়। রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে কাপাসিয়ার রাস্তা—দুই পাশে সবুজ আর লাল মাটির মায়াবী আহ্বান। যেদিনের কথা বলছি, তার কদিন আগেও প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুরো দেশ ছিল অতিষ্ঠ। যেই একদিন বৃষ্টি ঝরল, তখনই কাপাসিয়ায় যাওয়া ঠিক হলো। যাত্রাপথে টঙ্গীতে বৃষ্টির দেখা মিলল। কাপাসিয়ার সড়কে ওঠার সময় বৃষ্টি শেষ। কাপাসিয়া বাজারের পরই শীতলক্ষ্যার ওপর ফকির মজনু শাহ সেতু। পার হয়ে কিছু দূর গিয়ে ডানে রাস্তা। সরু, তবে পিচঢালা।
জায়গাটার নাম তরগাঁও, বছর চারেক আগেও একবার যাওয়া হয়েছে। তাই এবারে নতুন করে চোখে পড়ল সীমানাপ্রাচীর। ভেতরে কানিজ আলমাস খান ও হোসাইন নাসরাত আলী খান দম্পতির বাড়ি। রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান সৌন্দর্যচর্চার কেন্দ্র পারসোনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। হোসাইন নাসরাত আলী খান সাবেক ব্যাংকার, এখন পারসোনার চেয়ারম্যান।
সড়ক থেকে বাড়ির ফটক পেরিয়ে গাছপালার মধ্য দিয়ে বেশ কিছুটা গেলে চোখে পড়ে নদীর রেখা। নদীর কাছেই ছাউনি দিয়ে বসার জায়গা। সেখান থেকে আহ্বান জানালেন কানিজ আলমাস খান, ‘এখানে আসেন আগে। একটু কিছু মুখে দিন।’ চিনামাটির ছোট্ট বাটিতে সাদা নরম তালশাঁস। একদমই টাটকা। ‘আমাদের গাছের, আপনাদের জন্যই একটু আগে পেড়েছে।’ টাটকা তালশাঁস, সামনে নদী—ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজট আর খানাখন্দ ঠেলে গাড়ি চালানোর পর এ যে স্বর্গ।
যতটুকু জানি, কানিজ আলমাস বা নাসরাত আলী খান, কারোরই বাড়ি কাপাসিয়া এলাকায় নয়। তাই প্রশ্ন, এই জায়গার খোঁজ কীভাবে পেলেন? স্বামীর দিকে ইঙ্গিত করে কানিজ বলেন, ‘ওনাকে জিজ্ঞেস করেন।’
‘আমাদের নিজেদের কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। সেই সময়ে টাকাপয়সাও তেমন একটা ছিল না। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত আমাদের ছিল গ্ল্যামার বিউটি পারলার,’ বললেন নাসরাত আলী খান। এরপর পারসোনার শুরু। আরও পরে তাঁরা ভাবলেন, প্রকৃতির একেবারে মাঝখানে একটা জায়গা কিনবেন। নাসরাতের বোন থাকতেন গাজীপুরের মাস্টারবাড়ি। নাসরাত বলতে থাকেন, ‘সে আমাকে জায়গা দেখাত। পছন্দ হতো না। সেগুলোতেও গাছপালা, প্রকৃতি ছিল; কিন্তু আমি চাইতাম নদীর পাড়ের জমি।’ তো এভাবেই জমির দালালদের মাধ্যমে এই জায়গার খোঁজ পান নাসরাত আলী খান।
এটা গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়নে পড়েছে। ঢাকা থেকে দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারের মতো। ‘একবারে পুরো জায়গা কেনা হয়নি। একটু একটু করে কেনা হয়েছে,’ বললেন কানিজ আলমাস খান। ২০০৭–০৮ সাল থেকে কেনা শুরু। এখন জমির পরিমাণ ৫০ বিঘা। নাসরাত বলেন, ‘গাছপালা যা ছিল, সব রাখতে চেয়েছি। যে তালগাছগুলো দেখছেন, এগুলো তখন থেকেই ছিল। আর নতুন অনেক গাছ আমরা লাগিয়েছি। আগে বাউন্ডারি ওয়াল ছিল না। এ বছরই ওয়াল দেওয়া হলো।’ তবে নদীর পাড়ের অংশে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই, আছে কাঁটাতারের বেড়া। আগের গাছপালার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেহগনি, জারুল, হিজল, তমাল, বুদ্ধ নারকেল ইত্যাদি গাছ। ‘সরকারের বন বিভাগ থেকে যেসব গাছের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়, সেগুলোই আমরা এনেছি,’ বলেন নাসরাত।
গাছের তালিকা আরও দীর্ঘ। কানিজ আলমাস খান জানালেন, নতুন এসেছে জামরুল, অ্যাভোকাডো, বিশেষ জাম।
এখানে আছে ৬০টি তালগাছ। শিমুল, কৃষ্ণচূড়া যেমন আছে, তেমনি আছে আম, কাঁঠাল, আতা, শরিফা, লটকন, জাম্বুরা, বেল, বরইয়ের গাছ। বিদেশি গ্রিন থাই আম, পিয়ারসের সঙ্গে আছে শিলং থেকে আনা চেরি ফলের গাছও। যদিও ফল ধরেনি এখনো, গাছ বেড়ে চলেছে। মসলাপাতিও কম নেই। থাই আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, তিল, চুইঝাল...। তালিকা ক্রমেই বাড়ে।
জায়গাটাতে খামারবাড়ির একটা আবহ আছে। তবে সবুজ প্রকৃতি, নদীর হাওয়াই খেলা করে বেশি। গরু আছে ৮–১০টি। চীনা মুরগি, হাঁসের লালন–পালনও হয়। আছে ড্রাগন ফলের বাগান, থাই আদার খেত। তাল, নারকেল, সুপারি আগে থেকেই ছিল। কানিজ বললেন, ‘একটু ধানের খেতও আছে। পোলাওয়ের চাল হয়।’ এককথায় শাকসবজি, ফলপাকড়, আমিষ—সবকিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
‘নিজেদের কিছু হোক’, কানিজ ও নাসরাত আলী খানের এটাই ছিল চাওয়া। সেই ‘কিছু’ হওয়ার পর মনে হলো, মাঝেমধ্যে এখানে এসে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে হলে তো একটা ঘরও লাগবে। নাসরাত বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল মাটির ঘর করব। একজনের খোঁজ পেলাম। লাল মাটি আর পাথর দিয়ে নতুন এক কৌশলে তিনি ঘর বানান। তিনি কাজ শুরু করলেন। মাটি, পাথর ও চিপস মিশিয়ে দেয়াল উঠে গেল। কিন্তু মাঝপথে সেই কারিগর উধাও।’ এরপর স্থপতি ফয়সালের সাহায্যে বাড়ির নকশা ও নির্মাণ সম্পন্ন করা হলো। শেষমেশ মাটি ও পাথরের দেয়ালের ওপর ছাদ দিয়ে বাড়িটি দাঁড়িয়ে গেল।
নাসরাত আলীর গলায় একটু আফসোস, ‘পুরো প্রাকৃতিকভাবে বাড়ি করার ইচ্ছা ছিল, সেটা আর হয়নি।’ অবারিত প্রকৃতির মাঝখানে একতলা একটা বাড়ি। সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের এ বাড়ির সামনেটা খোলামেলা। গাছের নিচে বসার ব্যবস্থা। একতলা বাড়িতে তিনটি বড় ঘর, খাবার জায়গায় আধুনিক সুযোগ–সুবিধা সবই আছে প্রয়োজনমতো।
সেদিন সেখানে এসেছিলেন কানিজ আলমাস খানের মেয়ে নুজহাত খান, তাঁর স্বামী ইমরান আহমেদ এবং তাঁদের ছোট্ট মেয়ে নোরালীণ নুজহাত আহমেদ। নুজহাত খান বললেন, ‘প্রথম যখন দেখতে এলাম, তখন উঁচু জায়গা থেকে চরের মতো লাগত। নদী দেখে খুব ভালো লেগেছিল। এরপর তো এখানে এলেই ভালো লাগে।’
ঢাকায় খুব জরুরি কাজ না থাকলে সপ্তাহান্তে এসে দুই দিন এখানে থাকার চেষ্টা করেন তাঁরা। পরিবারের কনিষ্ঠ শিশু নোরালীণ এখানে এসে পায় ছোটাছুটির অবাধ স্বাধীনতা। তার নমুনাও দেখা গেল। আগের রাতেই জ্বর ছিল। কিন্তু নানা–নানি, মা–বাবার সঙ্গে এখানে এসে এদিক–ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। মোরগ–মুরগি ধরতে চাইছে। তাকে সামলাচ্ছে তার মা–বাবা। পারসোনার পরামর্শক থাইল্যান্ডের সুপাক থিপিয়াকোসাই জায়গাটা বিশেষ ভালোবাসেন। পারসোনা ও কানিজ পরিবারের সঙ্গে আছেন ১৬ বছর। বললেন, এই জায়গায় থাই আদাসহ নানা গুল্মলতা এনে চাষ করছেন। ‘যখনই আসি, আমার ভালো লাগে।’
ভালো যে কারোরই লাগবে। এমন প্রকৃতির সান্নিধ্য, গোছানো সবকিছু—মন জুড়ানো নদীর হাওয়া, গাছপালা—পাখিও তো কম নেই। হোসাইন নাসরাত আলী খানের ডাকনাম সবুজ। তাই কি সবুজে বসবাস করতে চেয়েছেন? হেসে বললেন, ‘নদী আমার খুব পছন্দ। নদীর কাছেই থাকতে চেয়েছি। যখন পারলাম, তখন আমরা ধীরে ধীরে এটি গড়ে তুলেছি।’ অনায়াসে জায়গাটা রিসোর্ট কিংবা পিকনিক স্পট করা যেত। কিন্তু তাঁরা সেটি করেননি। নাসরাত আলী খান বলেন, ‘অনেকেই চায় পিকনিক বা শুটিং করতে। আমরা চাই না। এখানে যে প্রকৃতি ছিল বা আছে, সেটা নষ্ট করতে চাই না।’ কানিজ যোগ করেন, ‘আমাদের নিজেদের, মানে পারসোনা কিংবা ক্যানভাস–এর প্রয়োজনে এখানে ফটোশুট হয়েছে, তবে সেটাও কম।’
এই বাড়ি কিংবা জায়গাটার কোনো নাম এখনো দেননি কানিজ আলমাস খান ও হোসাইন নাসরাত আলী খান। দুজনেই বললেন, উপযুক্ত সুন্দর নাম এখনো পাননি। পেলেই দেবেন। কথা বলতে বলতে আর পুরো জায়গাটা দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে যায়। পাখির কূজন বাড়তে থাকে। কাঠের পাটাতন ধরে হেঁটে নদী পর্যন্ত যাওয়া, বর্ষাকালে এই পাটাতনের নিচের জমিও শীতলক্ষ্যার পানিতে ভরে যায়। আমরা যখন যাই, তখন নদীজুড়ে কচুরিপানা। সেখানে বেগুনি সাদা হলুদ ফুল। বর্ষাকালে এই নদীর রূপ হয়ে ওঠে অপরূপ।
সপ্তাহান্তের জন্য এমন এক ঠিকানা ক্লান্তি দূর করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। নদী, নদীর ওপারে গাছে গাছে পাখির বাসা। তাই তো ‘যাও পাখি বলো তারে’ গানের লাইন ধার করে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘নদীর ওপার পাখির বাসা।’ পাখিদের সঙ্গে তাঁদেরও বাসা।