১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায়। সেদিন সেখানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলেন ডাকসু সংগ্রহশালার সংগ্রাহক ও আলোকচিত্রী গোপাল দাসের মা সুমতিবালা দাস। আমন্ত্রণপত্রও জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আর বঙ্গবন্ধুকে দেখা হয়নি সেদিন। সেই গল্প ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ছুটির দিনে–তে ছাপা হয়েছিল। এখানে তা পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
বঙ্গবন্ধুর ছবিটা দেখতে প্রায়ই ডাকসু সংগ্রহশালায় চলে আসেন তিনি। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ওই বৃদ্ধাকে সেদিনও পাওয়া গেল সেখানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। সাদা ধবধবে শাড়ির রংটা তাঁর মাথার পাকা চুলকে হার মানিয়েছিল। তাঁর হাতে ছিল বাঁধাই করা একটি আমন্ত্রণপত্র। তাঁর নাম সুমতিবালা দাস। বয়স ১০০ ছুঁই ছুঁই (২০১০ সাল)। এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে। বেশ আবেগভরা ছিল তাঁর মুখখানা। জানালার ফাঁক দিয়ে রোদের আলোর ঝিলিকটা খেলা করছিল সেই আবেগভরা মুখখানায়। তাঁর বলিরেখাময় হাতটা ধরে একটা উষ্ণ অনুভূতি বিনিময় হলো তাঁর সঙ্গে। তখনো ছবিটার দিকে তাকিয়ে উদাস তিনি।
হাতের বাঁধাই করা আমন্ত্রণপত্র দেখিয়ে একমনে বলতে লাগলেন তিনি...‘শেখ সাবেরে দেহার খুব সাধ আছিল। গোপালের কাছে কত্ত দিন ঘ্যানর ঘ্যানর করেছি। একদিন রাইতে গোপাল আইসা এই কার্ডটা দিয়া কইল, মা, শেখ কামাল পাঠাইছে তোমার লাগি। কাল সকালেই তোমারে শেখ সাবের কাছে নিয়া জামু।’
তারপর কিছুক্ষণ থামলেন। সময় দিলাম তাঁকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার। এই ফাঁকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম কার্ডটায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোটির নিচে লেখা, ‘জাতির জনক মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুভাগমন উপলক্ষে আগামী ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, বেলা ১১টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপাচার্য ও সিন্ডিকেটের সদস্যবৃন্দ আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।’ ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল। মা অনেক দিন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চেয়েছেন। এ কথা কামাল ভাইকে বলার পর তিনি আমাকে এই কার্ডটা দিয়ে বলেছিলেন মাকে নিয়ে আসতে।’ বললেন ডাকসু সংগ্রহশালার সংগ্রাহক ও আলোকচিত্রী গোপাল দাস।
সুমতিবালারা থাকতেন তখন মিরপুরের বাড়িতে। বাসায় পৌঁছাতে গোপাল দাসের সেদিন রাত ১২টার মতো বেজে গিয়েছিল। বাসায় পৌঁছে তাঁর মাকে কার্ডটা দিয়েছিলেন তিনি। ‘শেখ সাবেরে দেখতে পামু, মনডা এত্ত বড় হইয়া গেছিল তখন, কী যে আনন্দ লাগছে, কেমনে বুঝামো।’ আবার বলতে শুরু করলেন সুমতিবালা।
রাতে ছেলেমেয়েদের খাওয়াদাওয়া করিয়ে ঠিকঠাকমতো ঘুম পাড়িয়ে একটা সুন্দর ছাপা শাড়ি বের করে রাখলেন সকালে পরে যাওয়ার জন্য। তখন বিদ্যুৎ ছিল না বাড়িতে। কুপির আলোটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। ঘুম আসছিল না সেদিন রাতে। হঠাত্ করে বাইরের জোরে জোরে শব্দ এল কানে। বেশ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রথমে সবাই ভাবল, ডাকাত এসেছে। ভয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে কাঁপছিলেন তিনি। এভাবেই কেটে গেল সারাটা রাত। ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির গেটের বাইরে প্রচণ্ড আওয়াজ পেয়ে গোপাল গেলেন গেট খুলতে। গেট খুলতেই প্রতিবেশী রফিকের কাছে জানা গেল বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। ছেলের মুখে খবরটা শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন সুমতিবালা। হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন সেদিন। আজও কার্ডটির দিকে তাকিয়ে শেখ সাহেবের কথা ভাবেন তিনি। কার্ডটি ডাকসু সংগ্রহশালায় দিয়ে দেন সবাইকে দেখানোর জন্য। মাঝেমধ্যে তিনি নিজেও চলে আসেন ডাকসু সংগ্রহশালায়। বঙ্গবন্ধুর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। ‘আহা রে, শেখ সাবেরে দেখতে পারলাম না।’ এ আফসোস নিয়েই কেটে যাচ্ছে তাঁর দিন।