আজ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ নোভেনা হাসপাতালে মারা গেছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রোকিয়া আফজাল রহমান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বই পালন করেছেন তিনি। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ছিলেন মিডিয়াওয়ার্ল্ড লিমিটেড ও মাইডাস ফাইন্যান্সের চেয়ারপারসন; মিডিয়া স্টার ও এবিসি রেডিওর পরিচালক; বাংলাদেশ নারী উদ্যোক্তা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি। সেই ষাটের দশকেই তিনি ছিলেন মুসলিম কর্মাশিয়াল (বর্তমানে রূপালী) ব্যাংকের ম্যানেজার। তারপর বহু বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে নিজেকে নিয়ে যান অন্য রকম এক উচ্চতায়। সফল এই উদ্যোক্তাকে নিয়ে ২০০৫ সালের ১১ জুন প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে প্রকাশিত হয় এই প্রচ্ছদরচনা। লেখাটি আবার এখানে প্রকাশ করা হলো—
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে আর আর হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ)। আলুর ব্যবসা। সেখানকার ম্যানেজার সাহেব কোল্ড স্টোরেজের মালিককে জানালেন, ‘চাঁদাবাজেরা চাঁদার জন্য জুলুম করছে, চাপ দিচ্ছে। না দিলে কোল্ড স্টোরেজ ভেঙে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে।’ মালিক বললেন, ‘থানায় জিডি করুন।’ ম্যানেজার কাতর গলায় বললেন, ‘না, সেটা আমি করতে পারব না। তাহলে আমার বা আমার সন্তানের বিপদ হতে পারে।’ ‘ঠিক আছে, আমিই করব।’ আর আর হিমাগারের মালিক নিজের নামেই জিডি এন্ট্রি করলেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে সমস্যার কথা জানালেন। চাঁদাবাজেরা তাঁর সঙ্গে দেখা করল। অনেক কথাবার্তার পর সমঝোতার আভাস দিল। বলল, গ্রামে আসুন। মালিক গ্রামে গিয়ে তো বিস্মিত। স্কুল মাঠে বিরাট জনসভা! সবার সামনে চাঁদাবাজেরা বক্তৃতায় বলল, ‘তিনি এখান থেকে ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ গ্রামের মানুষদের জন্য কিছু করছেন না। আমরা তাঁর কাছে স্কুলের জন্য অনুদান চেয়েছিলাম। তিনি সেটা দেবেন না বলেছেন।’ মালিক বুঝলেন, তিনি একটা ষড়যন্ত্রের শিকার। গ্রামের মানুষদের সাক্ষী রেখে চাঁদাবাজেরা তাঁকে ফাঁদে ফেলতে চায়। মালিক দমলেন না। বক্তব্য দিতে উঠে উনি শুধু বললেন, ‘আমি আপনাদের যেকোনো ভালো কাজের সঙ্গে আছি। স্কুল করবেন? খুব ভালো কথা। আমাকে বলুন। আমি নিজে ঘর তুলে দিচ্ছি। কিন্তু নগদ টাকা আমি দেব না। শুধু স্কুল না, আপনাদের যেকোনো ভালো কাজে আমাকে শরিক রাখবেন। আমি আমার সাধ্যমতো করব। কিন্তু আমার ওপর জুলুম করে কিছুই পাওয়া যাবে না। আমি আমার মন থেকে দিতে চাই।’ চাঁদাবাজেরা দেখল এ তো বিপদ, পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে! তারা ভেবেছিল, এত লোকের সামনে নিশ্চয় তিনি বড় কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হবেন। অথচ হলো তার উল্টো। ওদের হয়ে লোকজন তাঁকে বোঝালেন, ‘গ্রামের মানুষ তো খুব আশাহত হয়েছে, ঠিক আছে আপনি ২ লাখ টাকা দিয়ে দেন।’ ‘না, দেব না।’ ‘ঠিক আছে ১ লাখ।’ ‘হবে না।’ ‘আচ্ছা ৭৫ হাজার দেন।’ ‘প্রশ্নই আসে না।’ এভাবে ৫০, ৩০ করে ১০ হাজার পর্যন্ত চাওয়া হলো। কিন্তু তিনি এক পয়সাও না দিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। পরে তিনি শুনলেন, গ্রামের মানুষ তাঁর এই দৃঢ়তায় উল্টো প্রচণ্ড খুশি। তাঁরাও জানেন চাঁদাবাজদের ধান্দা। কিন্তু কেউ তাদের উপেক্ষা করতে পারে না। তিনি যে তাদের মুখের ওপর ‘না’ করতে পেরেছেন, এ সাহসে গ্রামের মানুষ খুবই খুশি। কেউ কেউ বলেছেন, ‘ওরা কিন্তু মানুষও মারতে পারে। আপনি কী করে পারলেন।’ তিনি বললেন, ‘আমার মরণ যেদিন লেখা আছে, সেদিনই হবে। একদিন আগেও না, পরেও না। সুতরাং অযথা ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ এই মালিকের মা সাঈদা আলী আফজাল বলতেন, ‘রুকী, তোর বেশি সাহস।’ স্বামী আজিমুর রহমান বলতেন, ‘তুমি বেশি স্ট্রং।’ তিনিই আর আর কোল্ড স্টোরেজের মালিক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, নারী উদ্যোক্তা রোকিয়া আফজাল রহমান।
কলকাতা লরেটো হাউস স্কুলে পড়াশোনা করা রোকিয়া আফজাল রহমানের বাবা ছিলেন ব্যারিস্টার খন্দকার আলী আফজাল। সে সময় তিনি ছিলেন বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির প্রথম বাঙালি সচিব। তাঁর ১২ সন্তানকেই তিনি চেয়েছেন ভালো স্কুলে পড়াতে। রোকিয়া আফজাল ছিলেন ৮ নম্বরে। শৈশব-কৈশোরটা তাঁদের কেটেছে কলকাতা ও করাচিতেই। করাচিতে তিনি পড়তেন মেয়েদের কলেজ সেন্ট জোসেফে। রোকিয়া আফজাল রহমান মনে করেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া তিনি বন্ধুর মতো সহযোগী একজন স্বামীর সঙ্গে ৩৭ বছর জীবন যাপন করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কষ্ট স্বামীর মৃত্যু। বলছিলেন, ‘সিঙ্গাপুর থেকে চেকআপ করিয়ে ১৫ অক্টোবর আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করে দেশে ফিরলাম ২০ তারিখে। ২৩ তারিখে উনি মারা গেলেন। ২০০১ সালের কথা। আমার জন্য এই মৃত্যু মেনে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। মনে হলো, হঠাৎ সব ফাঁকা হয়ে গেল।’
বলছিলেন রোকিয়া আফজাল, ‘ছোটবেলায় আমি আমার বোনদের চেয়ে ভাইদের সঙ্গে বেশি খেলতাম। পুতুল নিয়ে কখনো খেলিনি। বরং সাইকেল চালাতে ভালোবাসতাম। একবার তো আমাদের একজন আত্মীয় মাকে বলেই বসলেন, “রুকী যে ওর কাজিনদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে, এটা কি ঠিক?” ওই আমলে আমি নিজেই করাচির রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে আমার বোনদের নিয়ে দোকানে যেতাম। আমার বাবা ছিলেন খুবই ধার্মিক মানুষ। তবে মেয়েদের ঘরে বসিয়ে রাখতে হবে, এমন কথা নাকি তিনি ধর্মে কোথাও খুঁজে পাননি। তাঁর উত্সাহ, আগ্রহ আর সমর্থনেই আমার শিক্ষা, আমার কাজকর্ম। ১৯৬২ সালে আমি যখন করাচিতে মুসলিম কর্মাশিয়াল ব্যাংকে (বর্তমানে রূপালী ব্যাংক) যোগ দিই, তখন পরিবারের অনেকেই “না” করেছিলেন। বলেছিলেন, মেয়ে হয়ে ব্যাংকের চাকরির দরকার নেই। পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে ইত্যাদি। কিন্তু একমাত্র বাবাই আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন। আমার বাবা মনে করতেন, কাপড়চোপড়, গয়না নয়, মেয়েকে আমি বিয়ের সময় শিক্ষাই উপহার দেব। বাবার কাছেই আমার লেখাপড়ার প্রথম হাতেখড়ি। বাংলা, উর্দু, আরবি ভাষায় বাবা ছিলেন খুবই দক্ষ। সে যাক, ১৯৬৪ সালে আমি ঢাকায় ব্যাংক ম্যানেজার হয়ে বদলি হয়ে আসি। তখনো আমার বিয়ে হয়নি। আমার ভাই বিদেশ থেকে পর্যন্ত বলেছিলেন, দরকার নেই ব্যাংকের চাকরিতে যাওয়ার। বাবা সাহস দিলেন। বললেন, ওর শিক্ষা, ওর যোগ্যতায় ও চাকরি করছে। ওকে থামাব কেন? সুতরাং ব্যাংক ম্যানেজার হয়ে ঢাকায় চলে এলাম।’
দুই ম্যানেজারের বিয়ে
রোকিয়া আফজালের সঙ্গে যখন আজিমুর রহমানের বিয়ে হয়, তখন তিনি সিলেটে চা-বাগানের ম্যানেজার। ব্যাংক ম্যানেজার আর চা-বাগানের ম্যানেজার, দুই ম্যানেজারের বিয়ে হলো।
মজার ব্যাপার হলো, সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে শুধু স্বামী-স্ত্রীর দেখা হতো। কখনো স্বামী আসতেন ঢাকায়, কখনো স্ত্রী যেতেন সিলেটে। তারপর স্বামী আজিমুর রহমান চাকরি বদলে ঢাকায় চলে এলেন, যেহেতু রোকিয়া আফজাল রহমানের চাকরিস্থল ঢাকা।
‘তার চলে যাওয়ায় আমি শুধু একজন স্বামীকেই হারাইনি, একজন বন্ধুকেও হারিয়েছি। একই সঙ্গে আমাকে একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। অন্যদিকে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি স্বামীর ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশাল দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। একদিকে মনের সঙ্গে যুদ্ধ, আবার মনকে শক্ত রেখে কাজ করে যাওয়া। আমার এই একাকিত্বের সময় ছেলেমেয়েরা আমাকে অনেক সময় দিয়েছে, মানসিক শক্তি জুগিয়েছে। আমার দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে ইমরান আমার সঙ্গে ব্যবসা দেখছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। দুজনই কাজ করছে। বড় মেয়ে মরিয়ম ব্র্যাকে এবং ছোট মেয়ে ফাইজা আড়ংয়ে কাজ করছে। মরিয়ম অবশ্য কেমব্রিজে পিএইচডি করতে গেছে। আমার মেয়েরা সব সময় চেয়েছে উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে। তাই তারা তাদের পেশা বেছে নিয়েছে এভাবেই। আমার ছেলের ঘরের নাতি ঈমান। সত্যি বলতে, ও এখন আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। আমার মনে হয়, ১০ বছরের ছোট্ট ঈমান ওর দাদার শূন্যতাকে ভরিয়ে দিচ্ছে।’
চাকরি ছেড়ে ব্যবসা
‘আমি চাকরি ছেড়েছিলাম শুধু আমার ছেলেমেয়েদের জন্য। আমি মনে করি, নিজের কাজ, নিজের ক্যারিয়ার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মা হিসেবে আমার প্রথম কর্তব্যই হচ্ছে সন্তানের দেখভাল করা। আমি চেয়েছি ছেলেমেয়েরা আমার সার্বক্ষণিক সাহচর্য পাক। যেকোনো অনুষ্ঠানে, যেকোনো দাওয়াতে সবাই জানত, ওই যে রুকী আসছে তার ছোট ছোট তিনটা ছানাপোনা নিয়ে। ছেলেমেয়েরা যখন একটু বড় হলো, বড় মেয়ের বয়স ১৫ আর ছোট মেয়ের ৮, তখন আমি ব্যবসা শুরু করলাম। সেটা ১৯৮০। নিজের ব্যবসায় সময়টাকে নিজের মতো করে ব্যবস্থা করা যায়। অফিসে বসে নিজের কাজ করেছি আবার পাশে বসিয়ে মেয়ের পরীক্ষার পড়া তৈরি করেছি। ছেলের প্রচণ্ড জ্বর। ওর মাথায় পানি ঢালছি আবার ম্যানেজার সাহেবকে বাসায় ডেকে এনে খাবার টেবিলে বসিয়ে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছি। প্রয়োজনে অফিসকে বাসা, বাসাকে অফিস বানিয়েছি। আর ভাবলাম, ব্যবসার জন্য তো আমাকে পরিশ্রম করতেই হবে, সুতরাং একটু বড় করেই ভাবি। তাই কোল্ড স্টোরেজ দিয়ে ব্যবসা শুরু করলাম। তখন অবশ্য আলুর ব্যবসায় ভালো পুঁজি বিনিয়োগ ছিল। কৃষিভিত্তিক ব্যবসা। দেশেই কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে। দেশেই আলু উত্পাদিত হচ্ছে। তা ছাড়া আমার জীবনটা ছিল শহরভিত্তিক। এই আলুর ব্যবসা করতে গিয়ে গ্রামের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ হলো। আমার যে ছোট ছোট চুল, তাতে কিন্তু কৃষকদের সঙ্গে মাটিতে বসে কথা বলতে, ওদের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না। ওদের সঙ্গে আমার চমত্কার যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
এই কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসা ছাড়াও এখন রোকিয়া আফজাল রহমান বিমা, রিয়েল এস্টেট, মিডিয়া ব্যবসায় নিজের পরিধি বিস্তৃত করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের ব্যবসার পাশাপাশি তাঁকে স্বামীর ব্যবসাও দেখতে হচ্ছে। তবে শুরুটায় তিনি স্বামীর ব্যবসায় যোগ না দিয়ে একেবারে স্বাধীনভাবে একক ব্যবসা শুরু করেন। যেখানে আমাদের দেশে এখনো অধিকাংশ নারী ব্যবসা-বাণিজ্য মানে বুটিক শপ, শাড়ির দোকান, খাবারের দোকানের গণ্ডি ছাড়াতে পারেননি, সেখানে ১৯৮০ সালে রোকেয়া আফজাল রহমান শুরুতেই শিল্প ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি গর্ব করে বলতে পারি, মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সততার সঙ্গে ব্যবসা করে। তারা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করে, ভ্যাট দেয়, ট্যাক্স দেয়। আমি সময়মতো ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করি বলেই আমার ব্যবসায় নগদ ঋণ (সিসি) পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের কাছ থেকে আমি ভালো ব্যবস্থাপক, ভালো উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মানটাও পেয়েছি। জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে প্রাইম কাস্টমার সম্মান পেয়েছি। অ্যামচেম পুরস্কার পেয়েছি।’ রোকিয়া রহমান মনে করেন, এসব সম্মান তিনি পেয়েছেন পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার ফল হিসেবেই। বললেন, ‘পরিশ্রম বা কাজকে আমি ভয় পাই না। তবে এর সঙ্গে ছিল আমার পারিবারিক সমর্থন। একবার আমার কোল্ড স্টোরেজের বিদ্যুৎলাইনের সমস্যার সমাধানে আমাকে হঠাৎ মুন্সিগঞ্জে যেতে হলো নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে দেখা করতে। দুর্গম পথ। নৌকায়, রিকশায় অনেকটা পথ যেতে হবে। আমি স্বামীকে একটা চিরকুটে শুধু লিখলাম, আমি অমুক জায়গায় এ কারণে যাচ্ছি, চিন্তা কোরো না। ব্যস, চলে গেছি। এই সমর্থন, বড় সমর্থন।’
কাঁধে যত দায়িত্ব
১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত পরপর দুই বছর এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য, মাইডাসের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, ওম্যান এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডব্লিউইএ) এবং ওম্যান ইন স্মল এন্টারপ্রাইজেসের (ওয়াইজ) সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ের দায়িত্ব ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল কাজ ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন। ওই বছরের আগপর্যন্ত প্রায় ১০টি কেন্দ্রে মহিলারা ভোট দিতে যেতে পারেননি। আমি সে সময় মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্বরাষ্ট্র, ধর্ম ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করি এবং যে ১০টি কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছিল, ব্যাপক সচেতনতামূলক কাজের মাধ্যমে সেই ১০ কেন্দ্রে ওই বছর মহিলারা প্রথম ভোট দিতে পারেন। আরেকটি কথা উল্লেখ করতে চাই, এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মাধ্যমে আমি আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। মন্ত্রণালয়ের নামটা আমরা বলতাম লেবার অ্যান্ড ম্যানপাওয়ার। “ম্যানপাওয়ার” কেন? মহিলাদের শ্রমশক্তিটি কি দেশের শ্রমশক্তি নয়? এখন অবশ্য কর্মসংস্থান বলা হয়। আমি যখন যেখানে সুযোগ পাই, নারীদের উন্নয়নের জন্য দুটো কথা বলি। ছয়টি বিষয়ে বক্তব্য রাখলে একটি অন্তত নারী উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে বলি। কারণ, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মেয়েদের উপস্থিতি খুবই কম। তাই ওদের হয়ে কিছু কথা পৌঁছে দিতে হবে নীতিনির্ধারকদের কানে।’
এ প্রসঙ্গে রোকিয়া রহমান বিশ্বাস করেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগ্য নারীদের দ্বিগুণ প্রমোশন দিয়ে হলেও নীতিনির্ধারক নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন। আমাদের নারীরা এখন কর্মী পর্যায়ে সংখ্যায় অনেক কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নগণ্য। তিনি আরও বলেন, নারীকে অনেক সময় ধর্মের কথা বলে এ সমাজে পিছিয়ে রাখা হয়। আমি যত দূর জেনেছি, আমাদের ধর্মে কোথাও নারীকে ঘরে বসিয়ে রাখার কথা বলা হয়নি। উল্টো আমরা দেখব ধর্মে মেয়েদের কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্যের উদাহরণ রয়েছে। ধর্ম বাধা নয়। বাধা আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদ চিন্তাশক্তি।’
১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজনে বিশ্বের নারী উদ্যোক্তা নেতৃত্বের পুরস্কার পাওয়া রোকিয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘আমি অনেক সংগঠনে অনেকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছি ঠিকই, তবে কোথাও কোনো পদে নারী প্রতিন্দ্বন্দ্বী থাকলে সেটা থেকে সরে দাঁড়াতে চাই। আমি মনে করি, মেয়েদের আসাটাই জরুরি। কাজ করতে গিয়ে ভুল-বোঝাবুঝি বা হিংসা-বিদ্বেষের মুখোমুখি যে হইনি, তা নয়। তবে আমি সাধারণত এগুলোকে মনে পুষে রাখি না। আর দ্বিতীয়ত, কেউ আমাকে কষ্ট দিলে তার জবাব দিই উল্টো ভালো ব্যবহার দিয়ে।’
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য গর্বিত
রোকিয়া রহমান বললেন, ‘একটা বিষয়ে আমি খুবই আশাবাদী। তা হচ্ছে, মেয়েদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা নারী উদ্যোক্তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি। ময়মনসিংহে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম, একজন ইমাম সাহেবের স্ত্রী বোরখা পরে এসে বলছেন, “এখন তো একজনের আয়ে সংসার চলে না। সুতরাং আমাদের কিছু না কিছু করতেই হবে।” ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা মাইডাসের ছোট ছোট ঋণ থেকে শুরু করে এখন মেয়েরা দল গঠন করে বড় অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েও ভালো ব্যবসা করছে। আগে তো মিনিমার্ট ভাড়া নিত মেয়েরা, এখন ৫০ লাখ টাকা দিয়ে তারা মিনিমার্ট কিনছে। মেয়েদের ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা, হিসাবের জ্ঞানবুদ্ধি খুব ভালো। সবচেয়ে ভালো তাদের ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রবণতা। দেশে যেখানে ঋণখেলাপিদের নিয়ে ব্যাংকগুলো বিব্রত, সেখানে মাইডাসে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ ফেরত দেওয়ার শতকরা হার ৯৯ দশমিক ৫। আমি তো রীতিমতো গর্বিত। মাইডাসে অবশ্য ছেলেদের ঋণ ফেরত দেওয়ার হারও খারাপ নয়। শতকরা ৯৫ ভাগ।’ তবে রোকিয়া আফজাল রহমান মনে করেন, পুঁজির সমস্যার চেয়ে এখন মেয়েরা প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি কিংবা যন্ত্রপাতি কীভাবে, কোথা থেকে আনা হবে কিংবা জমির মূল্যবৃদ্ধি...এসব দিক দিয়ে একটু পিছিয়ে পড়ে যান। কারণ, এখন পুঁজি পাওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্যতা মেয়েরা ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন। মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে স্বল্প সময়ের জন্য কার্যকর, বাস্তব উপযোগী ব্যবসাশিক্ষার প্রশিক্ষণ আরও বৃদ্ধি করলে হয়তো তাঁরা উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণটা জরুরি। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে টাফটস ইউনিভার্সিটি থেকে আমি ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলাম। এই প্রশিক্ষণ আমার কর্মজীবনের ব্যবস্থাপনায় খুব কাজে লেগেছে।’
ভালো লাগার কথা
‘আমি ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসি। ঢাকার বাইরে বের হলেই মনে হয়, মনটা ভালো হয়ে যায়। প্রকৃতি, নিরিবিলি আমার পছন্দ। পাহাড় আমাকে খুব টানে। দার্জিলিং কিংবা নেপালে গেলে মনে হয় হিমালয়ের খুব কাছে চলে এসেছি। অন্য রকম শিহরণ বোধ করি। নিজের কাজে আমাকে সুইজারল্যান্ড যেতে হয়। ওই দেশটার প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করে। আমি পড়তে ভালোবাসি। আমার যেহেতু প্রচুর ঘুরতে হয়, আমি সাধারণত যাত্রাপথে পড়ি। সফর মানেই বই সঙ্গী। আমি গান শুনতে আর সিনেমা দেখতেও ভালোবাসি। সময় হয়তো পাই না, কিন্তু সময় করে নিই। জামদানি শাড়ি আমার পছন্দের শাড়ি। তবে সুতি কাপড়ে আমার বিশেষ দুর্বলতা।
‘আমার জীবনে বাবাকে আমি আদর্শ মানুষ হিসেবে পেয়েছি। স্বামীকে পেয়েছিলাম বন্ধুর মতো। আর দীর্ঘ কর্মজীবনে যাঁদের আমি শ্রদ্ধা করি, যাঁদের দেশপ্রেম, দেশের উন্নয়নের প্রতি অঙ্গীকার আমাকে নাড়া দেয়, তাঁরা হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদ। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইউনূস ভাই ও আবেদ ভাইয়ের কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত। আর একজন নারী হিসেবে যিনি আমাকে ভেতরে শক্তি জোগান, তিনি বেগম রোকেয়া। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, যে কথা আজও বলতে সাহসের দম নিতে হয়, সে কথা কত আগে কত সরলভাবে বলে গেছেন তিনি।’