হঠাৎ যদি উপার্জনে নামতে হয়, তাহলে অনলাইনে কিছু কোর্স করে নিতে পারেন। প্রতীকী এই ছবির মডেল: জেবুন্নেসা
হঠাৎ যদি উপার্জনে নামতে হয়, তাহলে অনলাইনে কিছু কোর্স করে নিতে পারেন। প্রতীকী এই ছবির মডেল: জেবুন্নেসা

জীবনের মাঝপথে যদি আয়ের পথ খুঁজতে হয়

এখনো অনেক পরিবারে একজনই উপার্জন করেন। আবার অনেক নারীই আছেন, উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পরও বিয়ের পর আর চাকরি করা হয়নি। সংসার ও সন্তান নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনায় স্বামীর অবর্তমানে সেই নারীকেই ধরতে হচ্ছে পরিবারের হাল। তিনি হয়তো শিক্ষিত কিন্তু চাকরির কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আবার হয়তো এমন একটি বয়সে এসে পৌঁছেছেন যেখান থেকে শুরু করাটা কঠিন। এমন একটি পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডা রেখে আয়রোজগারের একটি পথ খুঁজে নিতে হয়। কীভাবে শুরু করবেন সেই কঠিন পথের লড়াই? জানাচ্ছেন ফারহানা আলম

নীলুফার বেগম। স্নাতকোত্তর শেষ করার পরপরই ঢাকার এক ব‌্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের ২০ বছরের মাথায় তিন মেয়ে, এক ছেলে রেখে হঠাৎ মারা যান তাঁর স্বামী। স্বামী চলে যাওয়ার শোকটাও ঠিকমতো করতে পারেননি নীলুফার—ওই অবস্থায়ই তাঁকে ভাবতে শুরু করতে হয়েছিল সংসার খরচ, সন্তানদের পড়াশোনা এবং একই সঙ্গে মা–বাবা দুজনের ভূমিকা পালন করার দায়িত্বের কথা। স্বামীর ব‌্যবসায়িক অংশীদার নীলুফারকে হিসাব দেখার দায়িত্বটা দিয়ে মাস গেলে ভালো অঙ্কের একটা টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে দিতে শুরু করেন। সেই শুরু। ছেলে বড় হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পরেই নীলুফার বেগমের দায়িত্বের বোঝাটা হালকা হয়েছিল।

হরিপদ দাস। ছেলেবেলায় স্বপ্ন দেখতেন একদিন তাঁর গ্রামের পরিমল ডাক্তারের মতো ডাক্তার হবেন। গ্রামের দুস্থ মানুষের চিকিৎসা করবেন। কিন্তু মুক্তিদ্ধের সময় সব স্বপ্ন এলামেলো হয়ে যায়। তিন ভাই ও চার বোনের পরিবার। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কোনো রকমে বসতবাড়ি মেরামত করে, বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায‌্য করতে টুকটাক কাজ শুরু করেন হরিপদ। ১৯৭২ সালে মেট্রিকুলেশনের পর কলেজে না গিয়ে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা পড়তে শুরু করেন। কারণ, দ্রুত আয়রোজগার করা যায় এমন একটা কর্মসংস্থান প্রয়োজন। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ভাইবোনদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করতে হবে। এরপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কানাডা সরকারের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ঘুরে সরকারি চাকরি করে এখন একটি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানে আছেন। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও ভাইবোন ও তিন সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা করেছেন।

যে বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে তেমন কোনো বিষয়ে কোর্স করাই ভালো

জুবাইদা রহমান কখনো ভাবতে পারেননি ২০ বছরের দাম্পত‌্য সম্পর্কের অবসান ঘটাবেন তাঁর স্বামী। স্বামী-স্ত্রী দুজনের আয়ে সংসারে যে সচ্ছলতা ছিল, এক মুহূর্তে তা যেন নাই হয়ে গেল। সংসার খরচ, সন্তানদের পড়াশোনা—সবটাই একা জুবাইদার কাঁধে এসে ভর করল। সে সময় কোনো সঞ্চয়ও তাঁর ছিল না। বরং স্বামীর ব‌্যবসার জন‌্য নিজের ব‌্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ছিল মোটা অঙ্কের ব‌্যাংকঋণ। বিচ্ছেদের পরেও যা বহন করে নিয়ে যেতে হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এতসব ধাক্কা সামলানোটা সহজ ছিল না। একটি কাজের মধ‌্যে ছিলেন বলেই ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত।

লায়লা খান ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিয়ে করেন। বিয়ের পরপরই মা হন। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু অকস্মাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় অচল হয়ে পড়েন স্বামী। পরিবারের আয়রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। স্বামীর প্রতিষ্ঠান থেকেও কোনো আর্থিক সহায়তা পাওয়া গেল না। আবার বাইরে গিয়ে নয়টা–পাঁচটা অফিস করাটাও লায়লার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেহেতু রান্নাটা লায়লা ভালোই জানেন, তাই বাড়িতেই একটা কিচেন সেটআপ করে, অনলাইনে খাবারের অর্ডার নিতে শুরু করেন। এই রান্না করা খাবার সরবরাহ করেই আর্থিক সংকটের একটা সমাধান করে ফেললেন।

প্রতিটি ঘটনাই সত্য। হয়তো কারও কারও ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু, আকস্মিক দুর্ঘটনা বা বিচ্ছেদ যে কারও জীবনেই ঘটতে পারে। এ ধরনের ঘটনায় শোক-দুঃখ সামলে উঠে সবচেয়ে বড় করণীয় পরিবারের অন্যদের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ানো। দ্রুত একটা কাজের মধ‌্যে ঢুকে পড়ে আর্থিক সংকট সমাধানের চেষ্টা যেমন করতে হবে, তেমনি এ ধরনের সংকট ভবিষ‌্যতে এলে কী করতে হবে, তারও একটা পরিকল্পনা থাকা উচিত।

জীবনের মাঝামাঝি এসেও আয়রোজগার শুরু করতে দরকার আত্মবিশ্বাস। মডেল: জেবুন্নেসা

এই সেদিন পর্যন্তও আমাদের দেশে পরিবারগুলোতে একজনই ছিলেন আয়ের উৎস। কিন্তু শিক্ষিত ও দক্ষ মানুষ হিসেবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়াটাও একধরনের দায়িত্ব—নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি ও রাষ্ট্রের প্রতি; একটা সময় এটা উপলব্ধি করতে থাকেন বিশেষ করে মেয়েরা। উপলব্ধি করে আত্মনির্ভরতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর স্বাধীনতার জন্যও এটা প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষের শিক্ষা ও বেড়ে ওঠায় পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রও বিনিয়োগ করে। তাই অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হওয়াটা ভীষণ জরুরি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংসার পুরুষ মানুষটিই চালাবে—এমনটাই হয়ে এসেছে অনেক বছর। নীলুফার, জুবাইদা বা লায়লার জীবনে অকস্মাৎ যে সংকট এসেছিল, শিক্ষা, দক্ষতা ও যোগ‌্যতা ছিল বলেই শেষ পর্যন্ত সেটা সামাল দিতে পেরেছিলেন তাঁরা। আর তাই সব সময়ে মনে রাখতে হবে, যেকোনো কাজ করে আয় করার জন‌্য শিক্ষার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে কোন কাজটিতে আপনি দক্ষ, কোন কাজটি আপনি মনের আনন্দ নিয়ে করতে ভালোবাসেন, সেটাও বুঝতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা এখন আর সেই জায়গায় নেই, যেখানে সংসারের আয়রোজগারের দায়িত্বটা কেবল বাড়ির পুরুষ মানুষটিরই হবে। বরং এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংসারে আর্থিক দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়াটাই সবার কর্তব‌্য।

নিজে কোন বিষয়ে দক্ষ, সেটা বুঝে সিভি তৈরি করুন

সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই তাদের কর্মজীবনের রূপরেখা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে বড় করতে হবে। হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনায় মানসিক শক্তি অর্জন থেকে শুরু করে পরিবারের পাশে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। হরিপদ দাস তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন‌্য বেছে নিয়েছিলেন এমন একটি পথ, যা তাঁকে দ্রুত কর্মসংস্থানের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারবে। লায়লা জানতেন তাঁর দক্ষতা কী, সেটাকে পুঁজি করেই আর্থিক সংস্থান করেছিলেন। তাই নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা এবং সময়মতো সেটা প্রয়োগ করতে পারতে হবে। কেউ হয়তো ভালো সেলাই জানেন, কারও ভালো লেখার হাত। কম্পিউটার চালনায় দক্ষতা থাকলে এই কাজ করেও নিজের আর্থিক চাহিদা মেটাতে পারবেন। ফ্রিল্যান্সিং করে দেশ–বিদেশের নানা কাজ থেকে আয় করা যায়। তাই যোগাযোগে দক্ষ হওয়াটাও জরুরি। মোটকথা একটা বয়সের পর নিজেকে হঠাৎ উপার্জনে নামতে হলে নিজের দক্ষতার দিকেই নজর দিতে হবে। কারণ, নতুন করে কিছু শেখার মতো অবকাশ বা সুযোগ আর তখন থাকে না। সেই কাজটাই করতে হবে, নিজে যেটা পারবেন।

আর স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে সংসারের জন‌্য আয় ও ব‌্যয় করলেও যাঁর যাঁর মতো সঞ্চয় থাকাটাও জরুরি। যেকোনো মুহূর্তে বিপদ হতে পারে, একজন আরেকজনকে ছাড়াই জীবন যাপন করতে হতে পারে, এ বিষয়টি মাথায় রেখে আর্থিক পরিকল্পনা করতে হবে। সন্তানদেরও মনে রাখতে হবে, সব সময় মাথার ওপর ছায়া হয়ে অভিভাবকেরা থাকবেন না। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে পরিবারকে সহযোগিতা করার জন‌্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। পরিবারের প্রতিটি মানুষ মিলে যেমন একটি দলের মতো, আবার প্রত‌্যেকেরই কিছু না কিছু নিজস্বতা রয়েছে। পরিবারকে সহযোগিতা করতে গেলে সবার আগে নিজের অবস্থান শক্ত করে তৈরি করতে হবে। দেশে-বিদেশে চাকরির বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের পেশার চাহিদা রয়েছে। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি যেকোনো বিষয়ে আলাদা করে দক্ষ হয়ে ওঠাটাও বিপদে কাজে আসবে।

তবে যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন‌্য আমাদের দরকার একটা সুন্দর পরিকল্পনা এবং বিকল্প পরিকল্পনা। সেই সঙ্গে জরুরি শিক্ষাগত যোগ‌্যতা এবং নিজেকে উত্তরোত্তর দক্ষ করে তোলার প্রচেষ্টা।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

করপোরেট কোচের প্রধান পরামর্শক যিশু তরফদার বলেন, ‘হঠাৎ যদি এমন কেউ মারা যান, যাঁর আয়ে পরিবারটি চলত, তাহলে বাকিরা তাঁর অবর্তমানে বিপদে পড়ে। এই অবস্থাকে বলে রিঅ্যাকটিভ বিহেভিয়ার। তাই প্রতিটি পরিবারে সব সময় ব্যাকআপ পরিকল্পনা থাকতে হবে। পরিবারের সবার মধ্যে এমন মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। একই সঙ্গে সদস্যদের সময়োপযোগী যেকোনো একটি দক্ষতার দিকে জোর দিয়ে সেটিতে উপযুক্ত হতে হবে। এমন দক্ষতার দিকে নজর দিতে হবে, যেটির বাজারমূল্য আছে, অর্থাৎ সেলেবল। এই অভ্যাস পরিবারের মধ্যে অবশ্যই চালু রাখা প্রয়োজন। আর প্রতিটি পরিবারেরই কিছুটা সঞ্চয় থাকা জরুরি। সেটি শুধু আয় করা মানুষটির অবর্তমানে কাজে লাগবে তা না, জরুরি অবস্থায় এই সঞ্চয় বিপদ থেকে বাঁচাবে।’

এ তো গেল ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হওয়ার পরামর্শ। কিন্তু এই মুহূর্তে যদি কেউ এমন অবস্থার মধ্যে পড়েন, তিনি কী করবেন? যিশু তরফদারের পরামর্শ হলো—প্রোঅ্যাকটিভ বিহেভিয়ার থাকতে হবে। আজকাল অনলাইনেই অনেক রকম কোর্স করা যায়। সময়োপযোগী তেমন কিছু বেছে নিয়ে দক্ষ হতে পারেন, এরপর একটু একটু করে সেই দক্ষতা সেল করতে হবে। আর এই সময়টার মধ্যে সঞ্চয় থাকলে সেখান থেকে একটু একটু করে সার্ভাইভ করতে হবে। পরিবারের সবার অবস্থার পরিবর্তনের মতো মানসিক অবস্থা (অ্যাডাপটেশন স্কিল ডেভেলপ) থাকতে হবে। সেই সঙ্গে নিজের দক্ষতা অনুসারে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। প্রতে৵কটি মানুষই কোনো না কোনো বিষয়ে দক্ষ। কেউ হয়তো দীর্ঘদিন কাজের মধ্যে না থাকায় সেটি ঢাকা পড়ে থাকে। তাই সময় নিয়ে ভাবতে হবে নিজে কোন বিষয়ে দক্ষ। সেটি কীভাবে কাজে লাগানো যায়। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে বেমানান কাজও করা লাগতে পারে, সেই মানসিকতা থাকতে হবে।’