নিজের কোনো শখ কখনো পূরণ করেছ বাবা?

আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। এ উপলক্ষে আমার পাঠকের কাছে আহ্বান করেছিলাম ‘বাবার কাছে খোলা চিঠি’। এই চিঠিটি লিখেছেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী রাগীব তাহসীন

বাবার সঙ্গে লেখক
বাবার সঙ্গে লেখক

প্রিয় বাবা, 

সাহস করে আজ না–বলা কথাগুলো বলব বলেই তোমাকে লিখতে বসেছি। সামনাসামনি বলার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোমার হাসি আর তোমার চোখে আমার জন্য অকৃত্রিম স্নেহ দেখে কেন যেন বলতে গেলেও গলা ধরে আসে, বলা হয় না। 

বুদ্ধির বয়স থেকে দেখে আসছি, তোমার পৃথিবীটা যেন আমাকে ঘিরেই ঘুরছে। সেই সকাল ছয়টা থেকে টিউশনি করিয়ে রাতে যখন বাসায় ফিরতে, বুঝতাম ক্লান্তিতে তোমার শরীর ভেঙে আসছে, কিন্তু আমার সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠতে ঠিকই। তোমার একটা কালো রঙের হিরো সাইকেল ছিল। তার সামনের রডে একটা সিট বানানো ছিল কাঠের ওপর ফোম দিয়ে, শুধু আমার জন্য। দিনটা যতই লম্বা যাক না কেন, সন্ধ্যায় ওই সাইকেলের ‘সিংহাসনে’ বসিয়ে তুমি ঠিকই পুরো জয়পুরহাট ঘুরিয়ে আনতে। 

বাইরের পৃথিবীটা ছোটবেলায় অনেক রঙিন লাগত। সামনে যা-ই দেখতাম, একটা না একটা বায়না করে বসতাম। অনেক সময় আবদার মেটাতে না পেরে তোমার মুখ শুকিয়ে যেত। কিন্তু পরে কীভাবে যেন আবদার করা সেই খেলনা তুমি ঠিকই এনে দিতে। আজ বুঝি, আমার বায়না পূরণ করতে গিয়ে তোমার নিজের শখ পূরণ হয়নি। তুমি বেশ ভোজনরসিক ছিলে। অথচ নিজের জন্য কখনো কিছু কিনে খেয়েছ বলে মনে হয় না। আর কত দিন আমার খাওয়া দেখে দেখে নিজের ক্ষুধা মেটাবে বাবা? একটু তো নিজের কথাও ভাবতে পারো। 

ছোটবেলায় আমি খুব অসুস্থ থাকতাম। সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিনই কাটত বিছানায়। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হতো। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন আমাকে নেবুলাইজ করতে হতো। গভীর রাতে আমাকে বুকে নিয়ে তোমার হাসপাতালে ছোটাছুটি, মাস্ক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া আর শার্টের কাপড় দিয়ে চোখ মোছা—দৃশ্যগুলো এখনো মনে পড়ে, জানো? তুমি ইনজেকশন ভীষণ ভয় পাও। কিন্তু আমার ইনজেকশন নেওয়ার সময় সাহস জোগাতে তুমিই। ঘুমের মধ্যে কতবার কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছ তার হিসাব নেই। তুমি ভাবতে আমি টের পাইনি। আমি কিন্তু ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতাম শুধু তোমার আদরটুকু পাওয়ার জন্য। 

ঈদে কখনো নিজের জন্য কাপড় কিনতে চাইতে না। তোমাকে কাপড় কিনে দিতে মাকে আজীবন যুদ্ধ করতে হয়েছে। অথচ আমার জন্য কাপড় কেনার সময় যখন গায়ে দিয়ে দেখতাম মাপে ঠিক আছে কি না, এমনভাবে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে, যেন রূপকথার কোনো রাজপুত্তুর দাঁড়িয়ে আছে তোমার সামনে। নিজের সব কটি শার্ট ছিঁড়ে গেছে, সেদিকে নজর আছে? এমনও হয়েছে, মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে কোনো কাপড় তোমার পছন্দ হয়েছে। বারবার নেড়েচেড়ে দেখছিলে, তা-ও আমি খেয়াল করেছি। সেই কাপড় কেনা হলো ঠিকই, কিন্তু তোমার জন্য না, আমার জন্য। আমার পছন্দের কাপড়ও আমার, তোমার পছন্দের কাপড়ও আমার, এ কেমন নিয়ম, বাবা? 

আমার সব সমস্যার সমাধান যেন তোমার কাছে। আমি যা-ই করেছি, যত বাধা টপকেছি, যত যুদ্ধ জিতেছি, তুমিই ছিলে আমার পাওয়ার হাউস। 

আজ সব সংকোচ কাটিয়ে বলতে চাই, আমার পছন্দের খেলনাগুলো আর লাগবে না। আমার আর চকলেট, আইসক্রিম লাগবে না। আমার যে কাপড় আছে, তা দিয়ে অনায়াসে চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি এক পা-ও হাঁটতে পারব না, বাবা। তোমার আদর পেয়ে পেয়ে আমি যে এখনো তোমার সেই ছোট বাবুই থেকে গেছি। ছোট বাবুই থাকতে চাই। 

ইতি, তোমার অয়ন বাবা