ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কেন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলাম

কদিন পর শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। পছন্দের বিষয়, নাকি পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়, কোনটিকে প্রাধান্য দেব? এ প্রসঙ্গে কথা হলো ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল (ইইই) বিভাগের প্রভাষক মো. মেহেদী হাসানের সঙ্গে। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথাই বললেন এই তরুণ শিক্ষক।

প্রতি সেমিস্টারের শুরুর দিন আমি ক্লাসে গিয়েই সবাইকে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেন এই বিষয়ে ভর্তি হয়েছ? তোমার ইচ্ছা ছিল, নাকি পরিবারের চাপে? কোনটার গুরুত্ব বেশি?’

প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী জানায়, তারা পরিবার ও অন্যান্য চাপে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্য শিক্ষার্থীরা নিজের ইচ্ছায় এসেছে। আমি খেয়াল করেছি, নিজের ইচ্ছায় পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা ক্লাসে মনোযোগী হয়। ল্যাবে সময় নিয়ে কাজ করে ও সঠিকভাবে বুঝতে চায়। সহজে পড়াশোনার চাপ নেওয়ার মানসিকতা রাখে। অন্যরা একটু বেখেয়ালি হয়। পড়ার ব্যাপারে উদাসীন থাকে। হতাশায় বেশি ভোগে। কিন্তু এ রকমটা কেন হয়?

আমার জীবনের গল্প থেকে কিছুটা উত্তর পাওয়া যাবে।

আমি সব সময় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বা তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশলে (ইইই) পড়তে চাইতাম। স্বভাবতই বুয়েটই ছিল প্রথম পছন্দ। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের কারণে বুয়েটে পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায়। লক্ষ্য বদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলাম। সুযোগ পেলাম ঢাবি এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট)। বিষয় পছন্দ না হওয়া এবং আরও কিছু কারণে চুয়েটে যাইনি। এদিকে মেধাতালিকায় নাম কিছুটা দূরে থাকায় ঢাবিতে পেলাম প্রাণিবিদ্যা। যথেষ্ট আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও পরিবারের সিদ্ধান্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামের কথা চিন্তা করে ভর্তি হলাম।

নিজের আগ্রহের সঙ্গে আপস করেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু হয়। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের’ জীবন বেশ উপভোগ্য। ক্যাম্পাস, লাল বাস, বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে আমার তখন সুন্দর জীবন। সমস্যা বাধল, যখন পড়াশোনা নিয়ে একটু সিরিয়াস হলাম। গণিত বা পদার্থের প্রশ্নের সমাধান করলে যে আনন্দ পাই, প্রাণিবিদ্যায় তো তা পাই না। মুখস্থ করতেও বিরক্ত লাগে। ফলে না পারছিলাম শিখতে, না পারছিলাম পরীক্ষায় ভালো করতে।

নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এভাবে চালিয়ে গেলে স্নাতক শেষে আমার অবস্থান কী হবে? এতটুকু বুঝলাম, গড়পড়তা ফলাফল নিয়ে লেখাপড়া হয়তো শেষ হবে। খুব ভালো করতে পারব না।

বিভ্রান্ত হয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কাছে খোঁজখবর নিলাম। মনে মনে ঠিক করলাম, পড়ার বিষয় পরিবর্তন করাই শ্রেয়। কিন্তু কোথায় যাব?

আমার সামনে তখন দুটো বিষয় এসে দাঁড়াল।

১. সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া কি ভালো হবে?

২. এই বিশাল খরচ দেওয়া আমার পরিবারের পক্ষে কি সম্ভব?

এই দুই প্রশ্নের কারণে আমার পরিবার রাজি হলো না। এর মধ্যে জানতে পারলাম, ভালো ফলাফল করলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি দেওয়া হয়। বাসায় খুলে বললাম। বললাম, দুই-তিনটা সেমিস্টার একটু সহযোগিতা করো, এরপর আশা করি আমি সামলে নেব। পরিবার রাজি হলো। অবশেষে পছন্দের ইইই নিয়ে পড়ার সুযোগ জুটল।

নিজের ওপর আস্থা রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই বাসা থেকে টাকা চাইতে গেলে খুব অপরাধবোধ হতো। তাই টিউশনির টাকা, বৃত্তির টাকা, শিক্ষকের সহকারী হিসেবে কাজ করার সম্মানী হিসেবে পাওয়া টাকায় পড়ালেখার খরচ অনেকটা আমি নিজেই দিয়েছি। তবু নেতিবাচক কথাবার্তা তো ছিলই। মানুষ শুধু প্রশ্ন করত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কেউ কি যায়?

আগামীর বিশ্ববিদ্যালয়–শিক্ষার্থীদের জন্য আমারও দুটি প্রশ্ন-

১. যেখানে আমার আগ্রহ নেই, সেখানে জোর করে শতভাগ চেষ্টা বা পরিশ্রম করা কি সম্ভব?

২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও খ্যাতি দেখে। এটা দেশের সেরা ও সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়, তা নিয়েও সন্দেহ নেই। কিন্তু শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে না পারলে এই খ্যাতি কোনো কাজে আসবে কি?

আগ্রহ না থাকলে পরিশ্রম করাও যেমন কঠিন, তেমনই কঠিন নিজের অবস্থান তৈরি করা। নিজের আগ্রহ, সঠিক পরামর্শ এবং একটু জানাশোনাই পারে তোমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন ও ভবিষ্যৎ পেশাকে আনন্দময় করে তুলতে।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল (ইইই) বিভাগের প্রভাষক মো. মেহেদী হাসান