ব্রাজিলভক্তদের উদ্দেশে যে খোলাচিঠি লিখেছিলেন অধিনায়ক দানিলো

চলছে কোপা আমেরিকা ২০২৪। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই টুর্নামেন্টের প্রারম্ভে ব্রাজিলভক্তদের উদ্দেশে এক খোলাচিঠি লিখেছেন অধিনায়ক দানিলো। পড়ুন দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন–এ প্রকাশিত সেই চিঠির নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

দানিলো

খোলাখুলি কিছু কথা বলি আজ।

অনেক দিন ধরেই আমরা যথেষ্ট ভালো খেলতে পারছি না। তার মানে এই নয় যে চেষ্টা করছি না, নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছি না, পরাজয়ের ব্যথা আমাদের হৃদয়ে হুল ফোটায় না। বরং ব্রাজিলের জাতীয় দলের জন্য আমরা সর্বস্ব উজাড় করে দিই। জার্সির জন্য আমরা কতটা আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত, কেন যেন সেটা ঠিক প্রকাশ করতে পারি না। কোপা আমেরিকায় আমার লক্ষ্য চিত্রটা বদলে ফেলা। অন্তত এটুকু নিশ্চিত করা, যেন মাঠে নিজেদের সবটুকু দিতে পারি।

এবার আপনাদের পালা। হোটেল-রেস্তোরাঁয় যখন ফুটবল নিয়ে আলোচনা হয়, বন্ধুদের কী বলেন? গণমাধ্যমে কী বলেন? কী ভাবেন আমাদের নিয়ে?

‘ওদের কিছুতেই কিছু যায়–আসে না।’

‘ওরা আসলে জয় চায় না।’

‘এরা সব ধনীর দল, জার্সির জন্য কোনো ভালোবাসা নেই।’

সত্যি বলতে, আমি বুঝি কেন আপনারা এসব বলেন।

আমাদের আর আপনাদের মাঝে একটা দেয়াল আছে। শুধু ব্রাজিলে নয়; এই দেয়াল সবখানে। এই দেয়াল আমাদের সমাজে। ইনস্টাগ্রামে ঢুকলে কী দেখেন? সবই কেমন ভাসা-ভাসা। সবাই সুখী। যেন সবাই সমুদ্রসৈকতে সময় কাটাচ্ছে। এই কাল্পনিক জগৎ তৈরিতে আমারও অবদান আছে। তাই কেউ যখন ভাবে, যা পেয়েছি তার মূল্য দিতে আমরা জানি না, আমি তাকে দোষারোপ করি না। কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে বলতে পারি, প্রত্যেক খেলোয়াড় ওই হলুদ জার্সির ওজনটা অনুভব করে, লোকে যে যা-ই বলুক।

‘এটা শুধুই আরেকটা ম্যাচ। চাপ গায়ে মাখছি না। আমরা পেশাদার খেলোয়াড়।’

ওসব ফালতু কথা! দলটার নাম ব্রাজিল, চাপ না থাকে কী করে!

প্রথম যেবার অনূর্ধ্ব–২০ জাতীয় দলে ডাক পেলাম, দিনটা কোনো দিন ভুলব না। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ ছিল। রাতভর শুধু ভাবছিলাম, লকার রুমে ঝোলানো আমার জার্সিটা দেখতে কেমন হবে? হলুদ, না নীল? ইশ্‌, যেন হলুদ হয়! পরদিন টেনশনে তিনবার জুতা পরিষ্কার করে ফেললাম। অবশেষে যখন লকার রুমে গেলাম, দেখলাম—

দানিলো

সেই নিখুঁত হলুদ জার্সি। সেই সবুজ সংখ্যা। আমার নাম! আহা! শিশুর মতো জার্সিটা হাতে নিয়ে বসে ছিলাম।

মনে মনে নিজেকে বলছিলাম, জীবন দিয়ে খেলো। নিজের সবটুকু দাও। বন্ধুর জন্য, পরিবারের জন্য। যারা এত দূর আসতে তোমাকে সাহায্য করেছে, সবার জন্য। দেশের জন্য। তুমি পারবে!

অথচ মাঠে নামার পর মনে হলো, ফুটবলে লাথি দেওয়াই ভুলে গেছি! এতই নার্ভাস লাগছিল যে সামান্য একটা পাস দিতে গিয়েও বল গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। জার্সির ওজন মনে হচ্ছিল ৫০ কেজি। টানা ৫০ মিনিট জীবনের সবচেয়ে বাজে ফুটবল খেলেছি। তারপর একটা হলুদ কার্ড পেলাম। মাঠ থেকে উঠিয়ে নিয়ে কোচ যেন আমাকে উদ্ধার করলেন।

ব্রাজিলের অধিনায়ক দানিলো

কিন্তু জানেন? যখন মাঠ ছাড়লাম, আমার দুঃখ হচ্ছিল না। নিজের ওপর রাগও না। কারণ, বুকে হাত রেখে বলতে পারি, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার করার ছিল না। আমি জীবন বাজি রেখে দৌড়েছি। মনে হচ্ছিল, এটা যদি ব্রাজিলের হয়ে আমার শেষ ম্যাচও হয়, অন্তত যেন নিজের সবটা দিয়ে যেতে পারি।

আমার কাছে ফুটবলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটাই—নিজের সবটা ঢেলে দেওয়া। কারণ, এমন অজস্র সময় আসবে, যখন আপনার পা কথা শুনবে না, যখন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম থেকে উঠবেন, যখন সারা পৃথিবী আপনাকে ঘৃণা করবে। যখন মনে হবে—আমি এই জার্সির যোগ্য নই। সেই অনুভূতি আমি খুব ভালো করে জানি।

দেখুন, আমি একজন মানুষ। সব সময় তো আর নিজের সেরা অবস্থায় থাকি না। সত্যি বলতে, রিয়াল মাদ্রিদে প্রথম মৌসুমেও ভীষণ হতাশ ছিলাম। মাঠে পাঁচ মিটার দূরের একটা পাসও দিতে পারছিলাম না। মাঠের বাইরে তো মনে হচ্ছিল নড়াচড়া করারও জোর পাই না। ফুটবলের প্রতি প্যাশন হারিয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, একটা জায়গায় আটকে গেছি। ইচ্ছা হচ্ছিল, ব্রাজিলে ফিরে গিয়ে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিই।

সে সময় আসলে নিজেকে বায়ানিনহো, বায়ানোর (বাবাকে লোকে তা-ই ডাকে) সন্তান মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল শুধুই দানিলো—৩১ মিলিয়ন ইউরোর খেলোয়াড়, সে সময় রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি ডিফেন্ডার।

জার্নালে লিখেও ফেলেছিলাম: মনে হয় ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে।

অথচ বয়স তখন মাত্র ২৪।

কয়েক মাস ভোগার পর একজন মনোবিদের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁর কাছেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা পাওয়া—আবারও একজন শিশুর চোখে খেলাটাকে দেখো।

শিশু বয়সে আপনি যখন ফুটবল খেলেন, তখন কিন্তু অত কিছু ভাবেন না। শরীর, মনের সামঞ্জস্য থাকে। সহজ কথায়, ভুলকে আপনি খুব একটা আমলে নেন না। শুধু খেলাটা উপভোগ করেন।

সেই থেকে নিজেকে ৩১ মিলিয়ন ইউরোর দানিলো ভাবা বন্ধ করে দিয়েছি। বরং নিজেকে ভাবি ব্রাজিলের বিকাস অঞ্চলের সেই দানিলো, যে পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে মিলে প্রত্যেকে এক রিয়াল করে দিয়ে প্রতি রোববার একটা পিৎজা কিনে ভাগ করে খেত। গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলতে মাত্র ৯০ সেকেন্ডের জন্য বন্ধুর ফোন ধার পেতে অনুনয়-বিনয় করত। ইন্টারনেট ক্যাফেতে একটু কম খরচে ই–মেইল করার জন্য দোকানমালিকের হাতে-পায়ে ধরত। প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তেলাপোকা, মাকড়সা, বিচ্ছুর সঙ্গে ঘুমাত।

ব্রাজিলের মানুষের আবেগের মূল্য যদি দিতে চাই, আমাদের আসলে মানসিকতা বদলাতে হবে। মাঠে আমাদের প্রতিটি দৌড় হতে হবে আপনাদের জন্য; যাঁরা আমাদের সমালোচনা করেন, আমাদের সামনের দিকে ঠেলে দেন, যাঁদের জন্য আমাদের কঠিন সময় কাটে, কিন্তু যাঁরা সত্যিকার অর্থেই আমাদের ভালোবাসেন, আমাদের দলটা নিয়ে ভাবেন।

এখানে আমরা আমাদের নতুন জুতার দেখনদারি করতে আসিনি, সেলফি তুলতে আসিনি। বরং ভক্তদের দেখাতে এসেছি, আমাদের শিরা-উপশিরায় রক্তের হলকা বইছে।

ইংরেজি থেকে অনুদিত