একটি শিশুর বিকাশে তার মা ছাড়া বাবা, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর ভূমিকা থাকে। তারপরও শিশুর বিকাশে যা কিছু তার পরিবার কিংবা সমাজের ‘মনের মতো’ হয় না, তার সব দায় গিয়ে মায়ের ঘাড়ে পড়ে। শিশুর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা যেমন। বহু বাড়িতেই অভিযোগ, শিশু খেতে চায় না। ছয় মাস বয়স থেকে বাইরের খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে শিশু। সেটিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের হাতেই হয়ে থাকে।
সন্তানের ঠিকঠাক না খাওয়ার ‘দোষ’টাও মায়ের ওপরে পড়ে। অথচ শিশুর না খাওয়ার পেছনে অনেক কারণই থাকতে পারে, যাতে মায়ের কোনো হাতই নেই। বাড়ন্ত বয়সে পুষ্টির চাহিদা বেশি থাকে, এটা ঠিক। শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ হলে, শিশু সুস্থ থাকলে, শিশুর মধ্যে বয়সসুলভ স্বতঃস্ফূর্ততা থাকলে বোঝা যায়, শিশু যতটুকু খাচ্ছে, ততটুকুতেই তার পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। তবে শিশুর খাবারদাবারের সঙ্গে শিশুর ও মায়ের মানসিক কিছু বিষয়ও জড়িত, এমনটাই বলছিলেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিন হক।
আজকাল অনেক পরিবারে মা-বাবা দুজনই ঘরের বাইরে কাজে যান। কিন্তু শিশু চায় মা-বাবার সান্নিধ্য। চায় তাঁদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ। সে এটাও বোঝে, তার দৈনন্দিন দেখভালের কাজগুলো করেই মা-বাবা বেরিয়ে যাবেন। তাঁদের আরেকটু বেশি সময় কাছে পাওয়ার জন্য, তাঁদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার জন্য খাওয়াদাওয়ায় অনীহা দেখাতে পারে শিশু। তাঁদের আটকে রাখাটাই তার মূল উদ্দেশ্য। কোনো অভিভাবক যদি মুঠোফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসে অতিরিক্ত সময় কাটান, তাঁর সন্তানও মনোযোগ পাওয়ার জন্য এমন আচরণ করতে পারে। অভিভাবক হিসেবে শিশুর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া মা-বাবা দুজনেরই কর্তব্য। কর্মজীবী হওয়া সত্ত্বেও দুজনেই কিন্তু সন্তানকে সময় দিতে হবে। দুজনকেই খেয়াল রাখতে হবে কোনোক্রমেই নিজেকে যাতে গুরুত্বহীন বা বঞ্চিত মনে না করে শিশু।
শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণেও খাওয়াদাওয়ায় অনীহা দেখাতে পারে শিশু। শিশুর মনের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অনেকেই উদাসীন থাকেন। কিন্তু যে শিশু হতাশায় ভুগছে, সে ঠিকভাবে খাবে না। তাই খেতে না চাইলে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও বিবেচনায় রাখুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীর ও মনের প্রতি যত্নশীল হওয়াটা পরিবারের দায়িত্ব। পরবর্তী সময়েও সন্তান লালন–পালনে পরিবারকে মায়ের সহযোগী হতে হবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে বহু মায়ের ওপর দিনকে দিন চাপ বাড়তেই দেখা যায়। ‘তুমি মা হয়েছ, তোমাকেই সব দেখতে হবে’, এমন মনোভাবের প্রকাশ ঘটলে একসময় এই চাপ সামলাতে অপারগ হয়ে পড়তে পারেন মা। পারিবারিক চাপ যেমন থাকে, তেমনি কখনো কর্মস্থলের সঙ্গে পারিবারিক জীবনের ভারসাম্যহীনতার কারণেও ভুক্তভোগী হন অনেকে। কর্মজীবী মাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করাটাও কিন্তু এ সমস্যার সমাধান নয়। একজন মা যদি নিজেই মানসিকভাবে স্থির থাকতে না পারেন, নিজেই যদি হতাশায় ভোগেন, তাহলে তিনি তাঁর সন্তানের দেখভালের কাজটা সঠিকভাবে করতে পারবেন না। এ রকম হলে সন্তানের খাওয়াদাওয়ার দিকটা ঠিক থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।