‘রাস্তাঘাটে মেয়েদের প্রায়ই উত্ত্যক্তের শিকার হতে হয়। খুব বাজেভাবে না হলেও আমি নিজেও দু–একবার এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি। এ জন্য আমার মনে হয়েছে, এসব দিক থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা দারুণ উপায় হতে পারে কারাতে শেখা।’ বলছিল নীলফামারীর ডোমার উপজেলার সোনারায় উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইশা আফরোজ। কারাতের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে ‘ইয়েলো বেল্ট’ পেয়েছে সে। এখন বিদ্যালয়ের আরও দুই ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাসের ফাঁকে ৩০ জন ছাত্রীকে কারাতে শেখাচ্ছে মাইশা।
মাইশার মতো এই অঞ্চলের এমন আরও অনেক ছাত্রীকে কারাতে শেখার এ সুযোগ করে দিয়েছে জয়েন্ট অ্যাকশন ফর নিউট্রিশন আউটকাম (জানো) প্রকল্প। বিভিন্ন স্কুলের ফাঁকা ক্লাসরুমে, মাঠে অথবা সরকারি কোনো খোলা জায়গায় কিশোরী এই মেয়েরা কারাতে শেখাচ্ছে বাকি ছাত্রীদের। জানো নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, কেয়ার বাংলাদেশ এবং স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। এতে অর্থায়ন করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অস্ট্রিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন।
শুরুতে মাইশার মতো কারাতের এ প্রশিক্ষণে রংপুর ও নীলফামারীর সাতটি উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে ১৭৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে জুলাই পর্যন্ত উপজেলাগুলোতে ছাত্রীদের আলাদাভাবে এ প্রশিক্ষণ হয়। ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে ‘বেল্ট’ ও সনদ পাওয়া এই ছাত্রীরা নিজেদের বিদ্যালয়ে ফিরে অন্য ছাত্রীদের কারাতের কৌশল শেখানো শুরু করেছে।
সোনারায় উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রীদের কারাতে শেখার বিষয়টির তদারক করেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক রমণীকান্ত রায়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার ছাত্রীরা যখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, তখনই আমাদের বলা হলো মেয়েদের অর্জিত দক্ষতা থেকে যেন বিদ্যালয়ের অন্য ছাত্রীরাও শিখতে পারে। এতে আমি উৎসাহিত হলাম। মেয়েদের জন্য আলাদা একটি কক্ষ ঠিক করে দিলাম। এখন সেখানে ৩০ জন ছাত্রী নিয়মিত কারাতের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।’
কারাতে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার পর থেকে ছাত্রীদের আত্মবিশ্বাসের ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করেছেন অভিভাবকেরা। রমণীকান্ত বলেন, ‘এখন আমার ছাত্রীরা যেকোনো বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক উদ্যমী। যেকোনো কাজ তারা খুব আগ্রহ নিয়ে করছে। আগে বিদ্যালয়ের মেয়েরা খেলাধুলায় কম আগ্রহ দেখাত। কিন্তু এখন তারা ফুটবল, ক্রিকেটসহ নানা রকম খেলায় বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।’
কারাতে শেখা ছাত্রী মাইশা আফরোজ জানায়, ‘কারাতে শেখার আগে কোনো কাজে যে পরিমাণ আগ্রহ পেতাম, এখন তার কয়েক গুণ বেশি পাই। আগে তার একা চলতে ভয় লাগত। মনে হতো বিপদে পড়লে কী করব, নিজেকে কীভাবে রক্ষা করব, সেই দুশ্চিন্তা হতো। কিন্তু কারাতে শেখার পর এখন নিজেকে বেশ স্বাধীন বলে মনে হয়। কোনো ধরনের বিপদ হলে আমি একাই মোকাবিলা করতে পারব—এ আত্মবিশ্বাস এখন আমার আছে।’
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার ১০টি বিদ্যালয়ের ২৫ জন ছাত্রীকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রমিজ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম দিন মেয়েদের মধ্যে যে আড়ষ্টতা ছিল, শেষ দিন কিন্তু তা দেখা যায়নি। বেশ পরিবর্তন দেখা গেছে তাদের মধ্যে। তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, শারীরিক শক্তির বিকাশ ঘটানোর একটা অনুপ্রেরণা পেয়েছে তারা।’
আয়োজন করে শেখানোর চেয়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া ছাত্রীরা যে নিজেদের বিদ্যালয়ে গিয়ে অন্য ছাত্রীদের শেখাচ্ছে, তা বেশি কার্যকর বলে মনে করছেন অনেকে। এতে তাদের দক্ষতা দারুণভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। উপজেলার অন্যান্য বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মাঝে কারাতের এ প্রশিক্ষণ ছড়িয়ে দিতে উপজেলা থেকে সহযোগিতার আশ্বাসও মিলছে।
জানো প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ ফয়েজ কাউছার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নারীদের অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে। কারাতের দক্ষতা যদি কোনো মেয়ের থাকে, তাহলে সে যেকোনো অসুবিধায় পড়লে আত্মরক্ষা করতে পারবে। এতে মেয়েদের মধ্যে যেমন কর্মতৎপরতা ও কথা বলার সাহস বেড়ে যায়, তেমনি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে এলে সেটি প্রতিরোধ করতে পারে। কিশোরীদের এ বিশেষ দক্ষতাটা শেখানোর মাধ্যমে আমরা চেয়েছি, তারাও নিজ বিদ্যালয়ে ফিরে অন্য ছাত্রীদের মাঝে সেটা ছড়িয়ে দিক।’
সাত উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে ছাত্রীরা টিফিনের বিরতিতে দল বেঁধে আধা ঘণ্টা করে কারাতে অনুশীলন করছে। তাদের জন্য বিদ্যালয়ে আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষকেরা।
জেন্ডারবিষয়ক শিক্ষা
কারাতের পাশাপাশি ছাত্রীদের জন্য নানা রকম শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে এসব বিদ্যালয়। বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সেখানে কিশোরীদের জন্য আছে নানা রকম ক্লাবও। ১৩ সেপ্টেম্বর ডোমার উপজেলার পাঙ্গা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ছাত্রীদের বয়ঃসন্ধিকালীন নানা পরিবর্তন, জেন্ডার সমতা ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে শ্রেণিকক্ষে পড়াচ্ছেন সহকারী শিক্ষক মো. আইবুল ইসলাম। ছাত্রীরাও বেশ সাবলীলভাবে শিক্ষককে প্রশ্ন করছে, কখনো কখনো নিজেরা উত্তর দিচ্ছে।
বিদ্যালয়ের সব শ্রেণির ছাত্রীরা সপ্তাহে এক দিন এই শ্রেণিকক্ষে এসে আইবুল স্যারসহ আরও তিনজন শিক্ষকের ক্লাস করে। ক্লাসটির নাম দেওয়া হয়েছে জেন্ডার ইক্যুইটি মুভমেন্ট ইন স্কুলস (জেমস ক্লাস)। শিক্ষক আইবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন পড়াশোনা করতাম, তখন নিজেরাও জানতাম না বয়ঃসন্ধিকাল কী। এ সময় কী মেনে চলতে হয় বা কী করতে হয়। তবে এখন আমাদের শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে জানে।’