খুব মজা করে পড়াশোনা করেছি, এখনো করছি: সেঁজুতি সাহা

সম্প্রতি এশিয়ার শীর্ষ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের দুই বিজ্ঞানী—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী ও অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সাময়িকী এশিয়ান সায়েন্টিস্ট এ তালিকা তৈরি করেছে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) পরিচালক সেঁজুতি সাহা। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম করোনাভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করেছেন। শিশুদের নিয়েও তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ কাজ আছে। বিশ্বে তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন, চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শুধু রক্ত নয়, শিশুর মস্তিষ্কেও বিস্তার লাভ করতে পারে। পড়ুন তাঁর সাক্ষাৎকার।

সেঁজুতি সাহা
ছবি: কবির হোসেন

নতুন করে আবার পড়ালেখার সুযোগ পেলে কোন বিষয়ে পড়তেন?

 ‘ও লেভেল’ এবং ‘এ লেভেল’-এ পড়ার সময় বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছি। পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যার সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি তো ছিলই। স্নাতক করেছি জৈব রসায়নে। আর পিএইচডির বিষয় ছিল সংক্রামক রোগ নিয়ে। নতুন করে পড়ার সুযোগ পেলে কোনো কিছু বদলাতাম না। কারণ, পড়াশোনার পুরো সময়টায় খুব আনন্দ পেয়েছি। খুব মজা করে পড়াশোনা করেছি, এখনো করছি। আর কাজ করে অসম্ভব আনন্দ পাচ্ছি। তাই নতুন সুযোগে কোনো কিছু পরিবর্তন করতাম না।

গবেষণা এমন একটা কাজ, যেখানে মনঃসংযোগ ধরে রাখাটা খুব জরুরি। কীভাবে মনঃসংযোগ ধরে রাখেন?

আসলে এটা সত্যি, এখন মনঃসংযোগ নষ্ট করার নানা উপাদান আছে। ফোন বাজছে, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে কিছু একটা পাচ্ছেন। এর মধ্যে সত্যিকারেই মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন। আমি যেটা করি, কাজের সময় ফোনের রিংটোন বন্ধ রাখি। ফোনটা ড্রয়ারে রেখে দিই, হাত থেকে দূরে রাখি। কখনো কখনো ২০ মিনিট বা ৩০ মিনিট ধরে অ্যালার্ম সেট করে রাখি। এ সময়টায় একেবারে মনোযোগ দিয়ে কাজ করি। পরে ফোন চেক করি। আবার ২০ থেকে ৩০ মিনিটের জন্য অ্যালার্ম সেট করে ফোনটাকে দূরে রেখে দিই । এভাবে মনোযোগ ধরে রাখি। এ ছাড়া আমি নিয়মিত ধ্যান করি। ট্রাফিক জ্যামে যখন আটকে থাকি, ধ্যান করি। যেন কাজ করার সময় মনোযোগ দিতে পারি।

বিজ্ঞানী হওয়ার যাত্রায় কোন সময়টা সবচেয়ে কঠিন ছিল?

নানা বাধা এসেছে। এখনো বাধা আসে। তখন ভাবি কী করে সামনের দিকে এগোব। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে জৈব রসায়নের অসম্ভব কঠিন একটা কোর্স ছিল। মিডটার্ম পরীক্ষায় ফল বেশ খারাপ হয়েছিল। মন খুব খারাপ হয়েছিল, কান্নাকাটিও করেছিলাম। তখন মনে হতো, আর কানাডায় পড়তে পারব না। দিনের পর দিন মাকে ফোন করে এসব বলতাম। জৈব রসায়নের যিনি শিক্ষক, তিনি আমাকে খুব বকাবকি করেছিলেন। বলেছিলেন, তোমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছ, কী যে পড়েছ, কীভাবে ভালো করবে? এটা শোনার পর অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। সে সময় মা–বাবা অনবরত সহায়তা দিয়ে গেছেন। তাঁরা বলেছেন চেষ্টা করতে। আমার ঠাকুরমা অনেক সহযোগিতা করেছেন। কথা বলে বলে আমার ধৈর্য ধরে রাখতে সহায়তা করতেন। তাঁদের জন্যই হয়তোবা পেরেছি সেই কঠিন সময় পার হতে।

গবেষক বা বিজ্ঞানী হওয়ার ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষার্থী, বিশেষ করে মেয়েদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?

আমাদের দেশে গবেষক বা বিজ্ঞানী হওয়ার পথে ছেলে বা মেয়ে, সবার জন্যই নানা ধরনের বাধা আছে। কিছু ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব আছে। আমরা যারা গবেষণাগারে বসে গবেষণা করি, তাদের গবেষণার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পেতে অনেক দেরি হয়। অনেক সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আনতে হয়। এসব সরঞ্জাম যাঁরা সরবরাহ করেন, তাঁরা এত বেশি মুনাফা করেন, তাতে উন্নত বিশ্বের চেয়ে এখানে বেশি দাম পড়ে যায়। এটা কিন্তু উল্টো হওয়ার কথা। আমাদের মতো দেশে তো দাম কম হওয়া উচিত। সরঞ্জাম খালাস করে আনতে অনেক টাকাপয়সা খরচ করতে হয়। একটু স্বল্প খরচে যদি গবেষণাগুলো করতে পারতাম, খুব ভালো হতো।

এবার আসি নারীদের বিষয়ে। তাদের সমস্যাটা সামাজিক। গবেষণার কাজে প্রচুর সময় দিতে হয়। তাকে সন্ধ্যার পর বা রাতে বাড়ি ফিরতে হতে পারে। আমাদের রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা একটা বিবেচ্য বিষয়। এসব জায়গায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণাগার থেকে বাড়ি পর্যন্ত ভালোভাবে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা থাকতে হবে। নারীদের জন্য বিশেষভাবে  দরকার পরিবারের সহযোগিতা। ছেলেরা কিন্তু বাড়ি গিয়েও গবেষণার কাজ করতে পারে, গবেষণা নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে, যেটা মেয়েদের বেলায় সব সময় সম্ভব হয় না। পরিবারে যেসব কাজ থাকে, সেগুলো ছেলে ও মেয়েরা যদি ভাগাভাগি করে নেয়, তাহলে মেয়েদের জন্য অনেক ভালো হয়। কর্মস্থলেও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুব দরকার।

‘জেন জি’র কোন গুণ বা দিক আপনার ভালো লাগে?

পরের প্রজন্ম, যাদের ‘জেন জি’ বলা হচ্ছে, তাদের অনেক কিছুই আমার ভালো লাগে। কিছু কিছু বিষয়ে তো হিংসাও করি। যেমন ওরা অনেক কিছু একসঙ্গে করতে পারে। ওদের জ্ঞান অনেক বেশি। শুধু ওরা বই বা বইয়ের সিলেবাসে আবদ্ধ থাকে না; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা শাখায় ওদের বিচরণ। ওদের জ্ঞান বৈচিত্র্যময়। আজকাল আমি প্রায়ই  দেখি, স্কুলের ছেলেমেয়েরাও কোডিং জানে। আমি অনেক বেশি বয়সে কোডিং শিখেছি। আমরা জানি যে বিজ্ঞানের যে শাখায় আমরা যাই না কেন, কোডিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটা জিনিস ভালো লাগে, ওরা অনেক জেদি। নিয়ম ভাঙতে পারে। বিজ্ঞানচর্চায় এটা জরুরি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে জেদ থাকাটা দরকার।

অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা

শিক্ষার্থী ও তরুণদের কোন তিনটি পরামর্শ দিতে চান?

প্রথম পরামর্শ হলো, কাজ আমরা সেটাই বেছে নেব, যেটা আমাদের ভালো লাগে, যেটা আমরা ভালোবাসি। কারও কথা শুনে যেন আমরা স্বপ্ন না দেখি। যেটা আমাদের ভালো লাগে, সেটাই করতে হবে। ভালো না লাগলে মন থেকে কিছু করা যায় না। আর মন থেকে না করলে সফল হওয়া যায় না। দ্বিতীয় বিষয় হলো কঠোর পরিশ্রম। আমরা যদি জীবনে ভালো করতে চাই, মানুষের জন্য কিছু করতে চাই, তাহলে পরিশ্রম করতে হবে। তৃতীয় যেটা বলব—আমরা যে কাজ করব, তাতে মানুষের কী লাভ হবে, এ নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের কাজ তখনই সার্থক হবে, যখন তা মানুষের কাজে লাগবে। 

কোন বিজ্ঞানীকে আপনার আদর্শ মনে হয়?

আমি বিজ্ঞানী পরিবারেই জন্ম নিয়েছি। মা–বাবা দুজনেই অণুজীববিজ্ঞানী। আমার চোখে এখন পর্যন্ত তাঁরাই আদর্শ বিজ্ঞানী। বাবা বিভিন্ন জীবাণু খুঁজে বের করেন। তাদের প্রতিরোধের উপায় খোঁজার চেষ্টা করেন। মা সারা জীবন কাজ করেন টিকা উৎপাদনে। রোগ প্রতিরোধে কীভাবে টিকার ব্যবহার করা যায়, সেটাই মায়ের কাজ। তাঁরা দুজনের আমার রোল মডেল।

ভবিষ্যতে কোন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হতে চান?

এখন তো আমি সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে কাজ করছি। আমি এবং আমার দল বোঝার চেষ্টা করছি, শিশুদের বিভিন্ন রোগের কারণ কী কী জীবাণু। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে রোগের ধরন বদলাচ্ছে। অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে আগের চেয়ে বেশি ক্যানসার দেখতে পাচ্ছি। কিডনিতে সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। ভবিষ্যতে এই রোগগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই। জিনগত যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই।