‘আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাদের মেয়ে পেরেছে’

নিজের শিক্ষাজীবন, আগ্রহ ও অনুপ্রেরণার কথা লিখেছেন রাজধানীর হলিক্রস কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া তানজিম মুনতাকা

গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে হলেও ঢাকাতেই বেড়ে ওঠা তানজিম মুনতাকার

আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে হলেও ঢাকাতেই বেড়ে ওঠা। ঢাকাতেই আমার স্কুল, কলেজ, সব। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের সঙ্গে সখ্য। শুধু পাঠ্যবই নয়, গল্পের বইও। ঈশপের গল্প দিয়ে শুরু, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিভিন্ন রকম বই সংগ্রহ করে পড়তাম। এই যেমন, কিছুদিন আগেই ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ১৫০টি বই একবারে কিনে নিলাম। অনেক আগে থেকেই আমার একটা লাইব্রেরি বানানোর ইচ্ছা; নিজস্ব একটা লাইব্রেরি, পছন্দের সব বই যেখানে থাকবে। বই পড়া আর সংগ্রহ করার মধ্যে অন্য রকম এক আনন্দ আমি পাই। ছোটবেলা থেকে পড়ুয়া স্বভাবের ছিলাম বলেই হয়তো মা-বাবা চেয়েছিলেন, বড় মেয়েকে চিকিৎসক বানাবেন।
২০১১ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখায় ভর্তি হই। ১০টা বছর, জীবনের সেরা সময়টা আমি সেখানে কাটিয়েছি।

এই স্কুলে আমার অনেক স্মৃতি—ভালো ফল, সব ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, বন্ধুবান্ধব। আর স্কুলের আপা, স্যাররা তো আমাকে সব সময় ভালোবেসেছেন। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর বিজ্ঞান বিষয়টা তিনটা ভাগে ভাগ হয়ে গেল—পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। আমাদের জীববিজ্ঞান পড়াতেন মৌসুমি আপা। আমার জীবনে আপার ভূমিকা একটু অন্য রকম। স্কুলের অগ্রজরা বলত, আপার বিষয়ে নম্বর তোলা কঠিন। আমিও দেখতে চাইলাম, কত কঠিন! জীববিজ্ঞানের পিছে বেশি সময় দিতে থাকলাম।


বাবার কাছে আমার গণিত শেখার হাতেখড়ি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তাঁর কাছে গণিত শিখেছি। গণিতে আমার দক্ষতাও ছিল বেশ। সেই আমি জীববিজ্ঞানের পেছনে সময় দিতে দিতে কখন যে জীববিজ্ঞানের প্রেমে পড়ে গেলাম, বুঝতেই পারিনি। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নটা তখন আরও বড় করে দেখতে লাগলাম। নবম শ্রেণির মাঝামাঝি সময়ে স্কুলের হেডগার্লের দায়িত্ব পাই। নেতৃত্ব দেওয়া, দলের সবার সঙ্গে কাজ করা, অনুষ্ঠান পরিচালনা, পড়াশোনা—সব মিলিয়ে সময়গুলো দুর্দান্ত কাটছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে বাসায় আটকা পড়লাম। প্রচুর অলস সময় তখন।

কাজ বলতে একটাই—গল্পের বই পড়া। বন্দী সময়ে কত যে গল্পের বই পড়েছি, হিসাব নেই।
২০২২ সালে সবকিছু যখন স্বাভাবিক হয়, আমিও আগের আমি হয়ে উঠি। মাধ্যমিকের পরও ভিকারুননিসাতেই থাকার ইচ্ছা ছিল। ভর্তি পরীক্ষা কেমন হয়, শুধু সেটা দেখার জন্য হলিক্রস কলেজে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। টিকে যাওয়ার পর ভাবনায় পড়ে গেলাম, কোনটায় পড়ব! আম্মুর ইচ্ছা আর সবদিক বিবেচনা করে হলিক্রসই ঠিক হলো। একটাই সমস্যা—বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব। একসময় এটারও একটা ভালো দিক খুঁজে পেলাম—রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কত ধরনের মানুষ দেখার সুযোগ পাই, অন্যরা কি পায় এই সুযোগ!

হলিক্রস কলেজে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সব ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষাটাও পেয়েছেন মুনতাকা


একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সব ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষাটাও কলেজেই পেয়েছি। কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার শিখার প্রতিটি কথা আমাকে নতুনভাবে চলতে শিখিয়েছিল। একজন শিক্ষার্থী, একজন নারীর সার্থকতা কোথায়, বুঝতে সাহায্য করেছেন তিনি।
উচ্চমাধ্যমিকের পর শুরু হলো ভর্তিযুদ্ধ। জীববিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা আর মা-বাবার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে মেডিকেলের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি; বরং পরিবার ও শিক্ষকদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। ফজরের নামাজ পড়ে পড়তে বসতাম, সামনে থাকত ঘড়ি। ঘড়ি ধরে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট পড়তাম। তারপর ৫ থেকে ১০ মিনিটের বিরতি, আব্বু-আম্মু, ভাই-বোনের সঙ্গে কথা বলতাম। তারপর আবার পড়তাম। এভাবে তিন মাস শেষ হলো, ভর্তি পরীক্ষা পার হলো।

পরিবার তাঁর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস


পরীক্ষা মনের মতোই দিয়েছিলাম। দুই দিন পর ফল দিল; আমার বাসার শিক্ষক রুম্মান ভাইয়াই প্রথম সুখবরটা জানান। শুরুতে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমি পেরেছি। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আম্মু তোমাদের মেয়ে পেরেছে।
আমার খালাতো বোন চিকিৎসক। সব সময় দেখেছি আপুর প্রতি আব্বু-আম্মুর স্নেহটা। দেখতাম, পরিবারের কেউ অসুস্থ হলেই আগে আপুকে কল করা হয়। ফল পাওয়ার পর এটাই মনে হচ্ছিল, আর কয়েক বছর পর যদি নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারি, তখন আপুর সঙ্গে আমিও তাদের সেবা করতে পারব।
এই সাফল্যের পেছনে আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেক মানুষের অবদান আছে। শুভাকাঙ্ক্ষীদের অবদান তো আছেই; যারা সমালোচনা করত, তাদের কথাগুলোও ভালো কিছু করার প্রেরণা দিত। মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন এবং স্কুল-কলেজ-বাসার শিক্ষকদের কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, সেটাকে আঁকড়ে ধরে জীবনের বাকি পথটুকু চলতে চাই।