মানুষ যেমন আশায় বাঁচে, ভালোবাসায় বাঁচে, তেমনি বাঁচে স্মৃতিতে। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন, স্মৃতি বেঁচে থাকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাহলে আমরা যারা নাইন্টিজ কিড, আমাদের সবার কাছেই একটা ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ আছে। সেই ট্রেজার আইল্যান্ডের নাম, দ্য সুইট নাইন্টিজ!
আজও, এখনো, এই এআইয়ের যুগে এসেও যে নাইন্টিজ আমাদের একটা বড় অংশের কাছে সবচেয়ে সুন্দর সময় হয়ে থাকল, এর কারণ আসলে কী? কেন আজও, এখনো, এসব পেয়েছির যুগে এসেও আমাদের সেই পুরোনো, ব্যাকডেটেড নাইন্টিজের জন্য মনটা এত পোড়ায়? বারবার আমরা স্মৃতির লেন হাতড়ে কেন নাইনটিজের অলিতে–গলিতে ঘুরে বেড়াই?
বলতে গেলে আসলে অনেক কিছুর কথাই বলা যায়। শীতের অলস দুপুরে বইয়ের মলাটের আড়ালে মায়ের চোখ এড়িয়ে ‘তিন গোয়েন্দা’ বা ‘মাসুদ রানা’ পড়ার যে তীব্র আনন্দ, এই আনন্দ কি আজকের ব্যস্ত সময়ে বসে অনুভব করা সম্ভব? সম্ভব না। বরং বিশটা টেক্সট বই, দুইটা কোচিং আর তিনটা প্রাইভেট টিউটরের চাপে খুন হয়ে যাওয়া এখনকার দুপুরগুলোতে বসে নাইন্টিজের সেই দুপুরগুলোকে মনে হয় সোনার হরিণ।
ভিডিওগেমস আজকাল একেবারে থ্রিডির যুগ পার করে ফেলেছে সত্যি, কিন্তু কয়েন জমিয়ে পাড়ার সেই পর্দা ঢাকা গেমসের দোকানে কয়েন কিনে মোস্তফা খেলার যে রোমাঞ্চ, সেই রোমাঞ্চ কি এখন প্লেস্টেশনের ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির মধ্যে আছে? নেই!
নাইন্টিজে টিভি চ্যানেল বলতে ছিল শুধু বিটিভি। তাও দিনের পুরো সময় পাওয়া যেতো না। ইউটিউবের বালাই ছিল না, চাতক পাখির মতো আমরা একটু টিভি দেখার জন্য বসে থাকতাম। বিজ্ঞাপন বা খবরের ‘জঞ্জাল’ পার হয়ে সেই টিভি দেখা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞই ছিল বটে।
আজকের এই হাতের মুঠোয় থাকা টিভি চ্যানেল আমাদের বিজ্ঞাপনমুক্ত হাজার হাজার কন্টেন্ট দেখার সুযোগ করে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু সেই যে বিটিভির ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘ইত্যাদি’, ‘ম্যাকগাইভার’ দেখার যে অসহ্য অপেক্ষা, সেই আনন্দ কি আজকের এই হাজারো টিভি চ্যানেল, ইউটিউব, ওটিটি মিলে ফিরিয়ে দিতে পারবে? পারবে না।
এখনকার ছেলেমেয়েরা বাংলা সিনেমা দেখে না। সিনেমা বলতে এখন আমরা বুঝি বলিউড, হলিউড আর নেটফ্লিক্স। সিনেমা বলতে আমরা এখন বুঝি বিশেষ একটা ব্যক্তিগত বিনোদনমাত্র। অথচ এই সিনেমাই যে নব্বইয়ের দশকে আমাদের কাছে ছিল একটা পারিবারিক উৎসব, সেটা এখন অনেকটা রূপকথার মতোই শোনাবে।
একেকটা শুক্রবার এলেই সবাই মিলে টিভি সেটের সামনে বসে পড়া, তারপর দুরুদুরু বুকে এই সপ্তাহের সিনেমার জন্য অপেক্ষা করার যে আনন্দ, সেই আনন্দের সঙ্গে কোনো নেটফ্লিক্স বা চরকির তুলনা হয় না। তাই আজ পৃথিবীর সমস্ত কনটেন্ট দেখেও আমাদের কাছে সেরা সিনেমা হয়ে থাকে ওই আলমগীর–শাবানার সিনেমাই। পৃথিবীর সেরা সেরা ওয়েব সিরিজ দেখা হয়ে গেলেও তাই আজও আমাদের কাছে জীবনের সেরা নাটকের নাম ‘কোথাও কেউ নেই’, এখনো আমাদের প্রিয় মুহূর্ত রাতে সবাই মিলে বসে মুনা, বাকের ভাইকে দেখতে দেখতে চোখের জল ফেলা।
শুধু নাটকই–বা কেন? আজকের বাংলাদেশের সবচে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট, এই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার বীজও পোঁতা হয়েছিল সেই নাইন্টিজেই। এখনকার জিততে শিখে যাওয়া টিম টাইগারদের জিততে দেখা অবশ্যই সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা, কিন্তু নব্বইয়ের সেই দুর্বল বাংলাদেশের হুট করে আইসিসি ট্রফি জিতে যাওয়া বা পাকিস্তানকে হারিয়ে দেওয়ার স্মৃতি আজও, এখনো মনে পড়লে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় না?
সব মিলিয়েই নাইন্টিজ ছিল কমপ্লিট একটা প্যাকেজ, ‘সিম্পলের ভেতর গর্জিয়াস’ একটা সময়। নাইন্টিজে ছিল একদিকে একের পর এক ব্যান্ডের উত্থান আর রাজনৈতিক পালবাদলে উত্তাল এক তরুণ প্রজন্ম। ছিল বই পড়া, গান আর আড্ডার একটা আলাদা জগৎ। ছিল প্রেমপত্র, ছিল সলজ্জ, স্নিগ্ধ, অব্যক্ত একপাক্ষিক ভালোবাসা আর ছিল ল্যান্ডফোনের দিনগুলোতে প্রেম।
না, নব্বইয়ের দশক সহজ ছিল না, স্বর্গও ছিল না। অনেক কমতি ছিল, অনেক ঘাটতি ছিল। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু এই কমতিগুলো মানুষ পূরণ করে দিয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে, মমতা দিয়ে, বন্ধন দিয়ে। এখন আমাদের মধ্যে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে, কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের গভীর, নিপাট আন্তরিকতা যেন নব্বইয়ের দশকে ফেলে রেখে এসেছি।
তাই আমরা সব পেয়েছির যুগে বসবাস করলেও আমাদের বারবারই ফিরে যেতে হয় নাইন্টিজে। বেগময় যান্ত্রিক জীবনে আমরা যতবার ক্লান্ত হয়ে যাই, ততবার আমাদের পেয়ে বসে নব্বইয়ের স্মৃতি, নব্বইয়ে ফেরার আকুতি।
এই আকুতিটুকু নিয়েই আমরা নাইন্টিজ কিডরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি। ফিরতে না পারার আফসোস আছে, থাকবে। তবে নব্বইয়ের দশক আমাদের যতটুকু সৌন্দর্য দিয়ে গেছে, যতটা আনন্দ দিয়ে গেছে, যতটা সুখস্মৃতি আমাদের দিয়ে গেছে, এই স্মৃতিটুকু মনে করে এই যে বিষণ্ন, ক্লান্ত দিনের শেষেও আমরা আনমনে হেসে উঠতে পারি, এ–ও কি আমাদের কম পাওয়া?