আমি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রার আর্টিস্ট। শহীদজননী জাহানারা ইমাম (যাঁকে আমি আম্মা বলে ডাকতাম) বিচিত্রায় ফোন করে বললেন, ‘তুই কি পাঁচটার দিকে বেইলি রোডে (এম আর আখতার) মুকুল ভাইয়ের সাগর পাবলিশার্সে আসতে পারবি? আমি থাকব। তোর সাথে দরকারি কাজ আছে।’
একটা ঘিয়ে রঙের ভক্সওয়াগন চালিয়ে আম্মা এলেন। এম আর আখতার মুকুল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ঢাকাইয়া ভাষায় ‘চরমপত্র’ নামে একটি কথিকা পাঠ করতেন। একাত্তর সালে খুব জনপ্রিয় ছিল এই কথিকা। দেশ স্বাধীন হলে লেখেন তাঁর বিখ্যাত বই আমি বিজয় দেখেছি। সাগর পাবলিশার্সে এসে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নিয়ে মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে বুদ্ধিপরামর্শ করতেন আম্মা। নতুন কোনো দরকারি বই এল কি না, খবর নিতেন। প্রতি মাসেই বই কিনতেন আম্মা। নিয়মিত বই পড়তেন, পড়া শেষ হলে প্রিয়জনদের পড়তে দিতেন। একাত্তরের দিনগুলির পাঠক প্রতিক্রিয়া আম্মাকে জানাতেন মুকুল ভাই।
ক্যাসেটে গান রেকর্ডিং করাতে এলিফ্যান্ট রোডের ‘গানের ডালি’তে নিয়মিত যেতেন আম্মা। গান শুনতে শুনতে বই পড়তেন। প্রখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফী রাত ১০টার দিকে আম্মাকে ফোন করতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নানা বিষয়ে পরামর্শ করতেন এবং নিজের ক্যানসার চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতেন। শেষে আম্মার অনুরোধে রবীন্দ্রসংগীত শোনাতেন।
একাত্তরের দিনগুলি বের হওয়ার পর কয়েকজন প্রকাশক আমার কাছে আসেন, জাহানারা ইমামের বই প্রকাশ করতে চান তাঁরা।
তার আগে জাহানারা ইমামের কয়েকটি বই বের হয়েছে। ‘ডানা প্রকাশনী’ থেকে তাঁর অন্য জীবন বের করেছিলেন শাহরিয়ার কবির। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাজী হাসান হাবিব। পল্লব প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল নিঃসঙ্গ পাইন। শিশুদের কিছু অনুবাদ বইও ছিল। আমেরিকা থেকে ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে আসার পর আমার বারবারের তাগাদায় লেখেন ক্যানসারের সাথে বসবাস। আম্মার কাছে একটা নোট বই ছিল। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর তাতে নানা বিষয়ে নোট নিয়ে রাখতেন। সেসব নোট অবলম্বনে মাস দুয়েকের মধ্যে লিখে ফেলেন ক্যানসারের সাথে বসবাস।
আম্মা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখনকার সরকার ঘাতক-দালালদের পক্ষ নেয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন আম্মা। আন্দোলনের পিঠে ছুরি মারতে নানা রকম লোক ঢুকে গেছে তখন। কে পক্ষে কে বিপক্ষে, বোঝা যাচ্ছে না। সে সময় আম্মা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছেন। বারবার শরীর খারাপ হয়েছে। মাঝেমধ্যে আমাকে গিয়ে তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাসা ‘কণিকা’য় থাকতে হয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মিটিং থাকত। আমেরিকা থেকে চিকিৎসা নিয়ে এসে খুব অস্বস্তিতে ভুগছেন। খেতে বসলে একটা আয়না সামনে রাখতেন। আয়নায় দেখতেন কতটা জিহ্বা বের হয়ে থাকে। মাড়ি ও ঘাড়ে অপারেশনে এবং দাঁত ফেলে দেওয়াতে, খাবার নরম করে খেতে হতো। শক্ত কিছু খেতে পারতেন না। ফলে কারও সামনে খেতে বসতে চাইতেন না।
মাঝেমধ্যে দেখতাম ক্যানসারে আক্রান্তরা তার বাসায় আসত। কাউকে কাউকে দেখতে হাসপাতাল যাচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহ করছেন।
শিল্পী কাজী হাসান হাবিব ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ধানমন্ডি মহানগর ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন। তাঁকে ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার চিকিৎসকেরা বলেছেন, রোগীর শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁকে বাঁচানো সম্ভব না। তাঁকে আপনারা দেশে নিয়ে যান। হাবিব ভাইয়ের আঁকা সমগ্র ছবি নিয়ে একটি বড় প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন তাঁর বন্ধু শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, সুবীর চৌধুরীরা। উদ্বোধন করেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে প্রদর্শনী দেখার মতো অবস্থা হাবিব ভাইয়ের ছিল না। প্রদর্শনীর একটি ভিডিও করেছিলাম, সেটিই তাঁকে দেখাই। প্রায় দিনই তখন আম্মাকে নিয়ে হাবিব ভাইয়ের কাছে যেতে হতো। হাবিব ভাইকে প্রফুল্ল রাখতে জুয়েল আইচকে নিয়েও ক্লিনিকে গেছেন আম্মা। জাদুশিল্পীকে দেখে হাবিব ভাই বলেছিলেন, ‘জুয়েল আপনার কাছে এমন কোনো জাদু নাই, যা দিয়ে আমার ব্যথাটা কমিয়ে দেওয়া যায়?’
কথাটা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন আম্মা।
হাসপাতালে হাবিব ভাইকে দেখতে এসেছিলেন সহপাঠী স্বপন চৌধুরী। গায়ক তপন চৌধুরীর বড় ভাই। হাসপাতালের বারান্দায় উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন তখন শিল্পী, সেই অবস্থাতেই মাথা তুলে বললেন, ‘স্বপন একটা রবীন্দ্রসংগীত গা।’
স্বপনদা গাইতে শুরু করলেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।’ ঘরের আর সবাই চুপ হয়ে গেল।
ব্যথায় পেটে ধরে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন হাবিব ভাই। চোখ বন্ধ করে গাইছেন স্বপনদা, চোখ দিয়ে টপটপ গড়িয়ে পড়ছে পানি। চোখ মুছতে মুছতে বেড়িয়ে গেলেন সংবাদ-এর আবুল হাসানাত।
বন্ধু লেখক, সাংবাদিক বেবী মওদুদকে একটি ডায়েরি উপহার দিয়েছিলেন কাজী হাসান হাবিব। বেবী আপা বললেন, ‘হাবিব একটা কিছু লিখে দাও।’
তিনি লিখলেন। ডায়েরির শুরুর কোনো পৃষ্ঠায় লেখার কথা। কিন্তু হাবিব ভাই ডায়েরির পাতার শেষ দিকে এসে হাসলেন। ২৫ ডিসেম্বর তারিখের ঘরে লিখলেন ‘জন্ম ও মৃত্যুদিন’।
অবাক হয়ে বেবী আপা জিজ্ঞেস করলেন, কী লিখলে?
হাসতে হাসতে হাবিব ভাই বললেন, ‘জন্মদিনে আমার মৃত্যু হলে তোমাদের মনে রাখতে সহজ হবে।’
হাবিব ভাইয়ের ডায়েরির লেখা বেবী আপা আমাকে দেখিয়েছিলেন। আম্মাও জানতেন। হাবিব ভাইয়ের অবস্থা হঠাৎই খারাপের দিকে চলে গেলে, কবি ফারুক মাহমুদ কয়েকজন লেখক বন্ধুকে নিয়ে আম্মাকে তার বাসায় জানাতে গেলে আম্মা বলেছিলেন, ২৫ ডিসেম্বরের আগে হাবিবের কিছু হবে না।
চার দিন পরই ২৫ ডিসেম্বর, কাজী হাসান হাবিবের জন্মদিন। বন্ধুরা তাঁর আয়োজন করছিলেন। সেদিনই মারা যান কাজী হাসান হাবিব। সেটা ছিল তাঁর ৪০তম জন্মদিন।
আমার স্ত্রী আসিয়ার স্তন ক্যানসার ছিল, সেও জন্মদিনে মারা যায়।