মুক্তির পরপরই সিনেমাপাড়ায় হুল্লোড় তুলেছিল থ্রি ইডিয়টস। বলিউডি এই সিনেমার গল্পে বুঁদ হয়েছিল ছেলে-বুড়ো সবাই। আপনি হয়তো বলবেন, কিন্তু সে তো এক যুগেরও আগের কথা, এখন আবার এই ছবির প্রসঙ্গ কেন? কারণ, আছে। কদিন ধরে এদেশের নেটপাড়ায় নতুন করে আবার হইচই তুলেছে এই থ্রি ইডিয়টস। তবে এটা রাজকুমার হিরানীর সেই বিখ্যাত সিনেমা না; বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর বানানো থ্রি ইডিয়টস সিনেমার কিছু দৃশ্যের রিমেক বা পুনর্নির্মাণ।
‘জিসু এন্টারটেইনমেন্ট’–এর ব্যানারে নির্মিত এই রিমেকের নির্মাতাদের খোঁজ করতে গিয়ে পাওয়া গেল শেখ জিসান আহমেদের নাম। জিসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকের ছাত্র। জিসু এন্টারটেইনমেন্ট নামের প্রযোজনা সংস্থার তিনি প্রতিষ্ঠাতা। মূল কারিগরও। সব কনটেন্টের পরিচালনা থেকে শুরু করে প্রধান চরিত্রে তিনিই থাকেন। জিসানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু থ্রি ইডিয়টসই নয়, আগে হলিউডের জোকার, তামিল ভাষার '৯৬, চঞ্চল চৌধুরীর বিখ্যাত মনপুরাসহ বেশ কিছু নাটক-সিনেমার কিছু দৃশ্য রিমেক করে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। এর বাইরে পথনাটক, মঞ্চনাটকেও কাজ করেছেন।
বিখ্যাত সিনেমাগুলোর বিশেষ দৃশ্য রিমেক করার পেছনে করোনাকালে ঘরবন্দী জীবনের একটা ভূমিকা আছে বলে জানান জিসান। ঘরে বসে থাকতে থাকতে হতাশা পেয়ে বসেছিল। হতাশা কাটাতেই আয়নাবাজি সিনেমার একটা দৃশ্য নিজের মতো করে পুনর্নির্মাণ করে আপলোড করেছিলেন। সেটা বেশ সাড়া ফেলে দেয়। দেখে খোদ চঞ্চল চৌধুরীও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। সেটিই মূলত পরের রিমেকগুলো করার প্রেরণা জোগায় জিসানকে।
মনেপ্রাণে একজন ভালো অভিনেতা হতে চান এই তরুণ। হুমায়ুন ফরিদী এবং চঞ্চল চৌধুরী তাঁর বড় অনুপ্রেরণা। মূলত অভিনয়কে ঘিরেই তার সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
শুরুটা হয়েছিল অনেকটা জেদ থেকে। গায়ের রং নিয়ে কটাক্ষ করত বন্ধুরা। কিছু একটা করে দেখানোর মানসিকতা নিয়ে অভিনয়ে নাম লেখান জিসান। যুক্ত হন উদীচী গোপালগঞ্জ জেলা সংসদ নাট্যদলে। অনেকে হাসিঠাট্টা করেছে। পরিবারও থিয়েটার করাটাকে সহজভাবে নেয়নি। এমনও দিন গেছে, থিয়েটারে সময় দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার কারণে তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে মাঝরাত অবধি। কিন্তু অভিনয়ের ভূত তত দিনে চেপে বসেছে। সে সময় হাত খরচ বাঁচিয়ে, ভাড়া বাঁচিয়ে তিনি থিয়েটারের কাজ চালিয়ে যান। গোপালগঞ্জে মেসে থাকাকালে একবার খাওয়ার জন্য কিনে রাখা ৩০টি ডিমের ২০টি বিক্রি করে দিয়েও পুরো সপ্তাহ কাটিয়েছেন। সব এই অভিনয় শেখার আগ্রহ থেকেই।
কঠিন সময় পেরিয়ে কিছু স্বীকৃতিও জিসানের ঝোলায় যোগ হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে অভিনয় প্রতিযোগিতায় সেরা হয়ে এক সময় এটিএন বাংলার ‘আগামীর তারকা ২০২০’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখান। সেখানে অভিনয় ক্যাটাগরিতে সাত হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। এই অর্জন পরিচিতদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছিল। একসময় যারা হাসি–তামাশা করত, তারাও প্রশংসা করতে শুরু করে তখন।
নিজের কাজ ছড়িয়ে দেওয়া ভাবনায় জিসান প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিসু এন্টারটেইনমেন্ট’। চিত্রগ্রহণে থাকেন কলেজজীবনের বন্ধু তানভীর, যিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। এ ছাড়া ক্যামেরার সামনে-পেছনে কাজ করেন আরও অনেক কাছের মানুষ। মূলত নিজেদের পকেট খরচের টাকাই তাঁদের সম্বল।
কিছু কিছু সিনেমা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিন থেকে চার মাস সময় লেগে যায়। অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা থেকে শুরু করে প্রপসের জোগাড়যন্ত্র—সব কাজ তিনি নিজেই করেন। বন্ধুরা পাশে থাকে বলে কিছুটা সহজ হয়। সব সংকটের মধ্যেই তিনি অভিনয় চালিয়ে যেতে চান।
জিসান বলেন, ‘বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের স্বপ্ন থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমার অবশ্য শুরু থেকেই স্বপ্ন ছিল জাহাঙ্গীরনগরের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে পড়ব।’ সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে চান তিনি।