ইনজুরিতে পড়ে যেভাবে ইংরেজি শিখলেন ব্রাজিলের এই খেলোয়াড়

ব্রাজিল ফুটবল দলে ফরোয়ার্ডে খেলেন গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেলি। বিশ্বকাপ শুরুর কিছুদিন আগে তাঁর একটি লেখা প্রকাশ করেছে প্লেয়ারস ট্রিবিউন ডটকম। সেখানে তিনি বলেছেন তাঁর পরিবারের কথা। শুনিয়েছেন ছোটবেলার গল্প।

গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেলি
ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

আমরা সবাই জানতাম, বিশ্বকাপের জন্য ব্রাজিল ফুটবল দলের প্রধান কোচ তিতে ২৬ জন খেলোয়াড়কে বেছে নেবেন। শান্ত হয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার ছিল না। কিন্তু আমার মাথার ভেতর হাজারো হিসাবনিকাশ চলছিল।
ফরোয়ার্ডের জন্য কয়জনকে নেওয়া হবে? কে কে আছেন? ওনার কি আমাকে প্রয়োজন? আমাকে কি নেবেন? ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে গেছি।
যখন তিতে ফোন করলেন, ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, একটা কল্পনার জগতে বাস করছি।
আমার গল্প জানতে হলে আপনাকে আমার বাবা জাও সম্পর্কে জানতে হবে। তাঁর জন্যই আজ আমি এখানে। ছয় বছর বয়সে বাবা আমাকে ব্রাজিলের অন্যতম বড় ক্লাব, কোরিন্থিয়ান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। এমন পাগলামি কে করে বলুন? বাবাদের তো সন্তানকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর কথা। অথচ আমার বাবা সব সময় বলে এসেছেন, ‘খোকা, যখন তোমার বয়স ছয় হবে, তখন তোমাকে নিয়ে যাব…’
তিনি জানতেনও না, আমি আদৌ ভালো খেলতে পারব কি না। তবু সাও পাওলোতে বাড়ির পাশের কোর্টে আমরা প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতাম। গোলপোস্টে কোনো জাল ছিল না। আমি বাবার কাঁধে চড়ে বসতাম। কোর্টে পৌঁছেই শুরু হয়ে যেত আমার ছোটাছুটি। ‘বাবা, চলো কাটাকুটি করি! চলো খেলি!’

বাবা বলতেন, ‘আহহা, না না। আজ তোমার বাঁ পায়ের প্রশিক্ষণ হবে।’
বাঁ পা! ভাবুন, তখনো আমার বয়স ছয় হয়নি। বাবা গোলপোস্টে দাঁড়াতেন। আমার দিকে বল এগিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘বাঁ পায়ে মারো। আবার মারো। আবার। এভাবে ১০টা, ১০০টা…’
আমি সব সময় অভিযোগ করতাম। বলতাম, ‘উফ! বাবা…’
আমি তো খেলাটা উপভোগ করতে চাইতাম। ‘একদিন পেশাদার খেলোয়াড় হব’—ওসব আমি বলতাম না। টিভিতে বিশ্বকাপ দেখে মনের ভেতর স্বপ্ন জাগত, সেটা ঠিক। যখন আপনার বাড়ির সামনের দিকটা পতাকার রঙে রাঙানো হবে, বাড়ির ১৫ সদস্য পেছনের উঠানে এক হয়ে টিভি দেখবে, বেলুন থাকবে, আতশবাজি ফুটবে, কাজিনরা ছোটাছুটি করবে, চাচা বারবিকিউয়ে হাত লাগাবেন, বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন না দেখে আপনি থাকবেন কী করে?
তবে সত্যিকার অর্থে, বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবিনি, আমি শুধু খেলতে ভালোবাসতাম। মা বলতেন, পাগল ছেলেটা সারা দিন শুধু দৌড়ায়।

গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেলি



বকবক বকবক
১০-১১ বছর বয়সে কোরিন্থিয়ান্স ছিল আমার ক্লাব। আশপাশের যেসব ছোটখাটো ক্লাবে বাবার চেনা লোকজন ছিল, সেখানেও খেলতাম। মাঝেমধ্যে দেখা যেত, এক দিনে আমার তিনটা খেলা পড়ে গেছে। ছুটির দিন বিসর্জন দিয়ে মা-বাবা আমাকে নিয়ে এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে ছুটতেন।

কিন্তু যদি খারাপ খেলতাম, তখন? মনে হতো, বাড়ি ফেরার পথটা অনেক লম্বা।
বাবা কখনোই আমাকে বকাঝকা করতেন না। কিন্তু বকবক করতেই থাকতেন, ‘গ্যাব্রিয়েল, তুমি ওটা না করে এটা করতে পারতে…’ উফ, আমি জানি কী করতে পারতাম! আমার মন এমনিতেই খারাপ থাকত। কী করতে পারতাম, সেটা আরেকজনের কাছে শুনতে ইচ্ছা করত না। বাবা বলেই যেতেন, ‘মনোযোগ দিতে হবে গ্যাব্রিয়েল, মনোযোগ…’
উফ! মাঝেমধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতাম। বাবা তবু বকেই যেতেন। এভাবে ঘণ্টাখানেক বকবকের পর বাবা থামতেন। মনে মনে ভাবতাম, আহ, কী সুন্দর নীরবতা, কী শান্তি!
কিন্তু তখনই শুরু করতেন মা, ‘গ্যাব্রিয়েল, তোমার লাথিতে কোনো জোর নেই। তোমার আরও জোরে লাথি মারা উচিত…।’
আমি বলতাম, ‘উফ, মা! দোহাই লাগে, থামবে? যথেষ্ট শুনেছি তো, নাকি?’
আমার বয়স যখন ১৪, বাবা একটা নতুন চাকরি পেলেন। অতএব আমাকে কোরিন্থিয়ান্স ছাড়তে হলো। ভীষণ কান্নাকাটি করেছিলাম। এরপর যোগ দিই ইতুয়ানোতে। ছোট ক্লাব। কিন্তু আজ বুঝি, ইতুয়ানোই আমাকে ফুটবলার বানিয়েছে। আমার এজেন্ট রাফায়েলকে সেখানেই পেয়েছি, আজও তিনি আমার সঙ্গে আছেন। কিন্তু বাবা সব সময় বলতেন, আমার একটা প্ল্যান বি থাকা উচিত। মা সব সময় বলতেন, আমি যেন কলেজে যাই। এখনো বলেন।

ইনজুরিতে ইংরেজি
২০১৯ সালে যখন লন্ডনে এলাম, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘুম হতো না। শুরুর দিকে মা-বাবা আর রাফায়েল আমার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু কখনো কখনো আমাকে একা থাকতে হতো। আর বাড়িতে একা থাকলে কখনোই আমার ঘুম হয় না। একা থাকলে সারা রাত আমার বান্ধবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলি। এসব কথা কিন্তু মজা করে বলছি না। দিনের বেলায়ও আমি একা থাকতে পারি না।

বান্ধবীর সঙ্গে গ্যাব্রিয়েল


সপ্তাহে তিন দিন ইংরেজি ক্লাস করতাম। বান্ধবীর সঙ্গে সিনেমা দেখতাম। ওকে আমি ভালোবাসি, কিন্তু এটা-ওটা নিয়ে আমাদের লেগেই থাকে। যদিও সে রিওর মেয়ে, কিন্তু সব সময় ইংরেজি সিনেমা দেখতে চায়। আমি চাই পর্তুগিজ ভাষায় রূপান্তরিত ছবি।
সে বলে, ‘তুমি ইংরেজি শিখছ, অথচ ডাবিং করা ছবি দেখতে চাও?’ কিন্তু সিনেমার পাত্রপাত্রীদের মুখে পর্তুগিজ ভাষা শুনেই আমি অভ্যস্ত। অন্য কণ্ঠস্বর কেমন যেন বেমানান লাগে। আমার বান্ধবী বলে, ‘আরে বোকা, এটা তো ওদের সত্যিকার কণ্ঠস্বর না। ওরা ইংরেজিতেই কথা বলে, পর্তুগিজে না।’
এমনিভাবে মা-ও আমাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে গোল করার আগে যেমন মাকে বললাম, ‘মা, কাল আমি গোল করব। তোমার কী মনে হয়? আমার উদ্‌যাপনটা কেমন হওয়া উচিত?’
মা বললেন, ‘বিরক্ত কোরো না তো। আমি রান্না করছি।’ হা হা হা!
দুই হাত বুকের কাছে আড়াআড়িভাবে ধরে বললাম, ‘এমন করলে কেমন হয়?’
মা বলল, ‘হুম, এটা ঠিক আছে।’
কিন্তু সত্যিই আমার সাহায্য দরকার ছিল তখন, যখন ২০২০ সালের গ্রীষ্মে ইনজুরিতে পড়লাম। প্রশিক্ষণের সময় হাঁটুতে ব্যথা করছিল। চিকিৎসক বললেন, আমার কার্টিলেজ ক্ষয় হয়ে গেছে। ব্যাস, পাঁচ মাস ঘরে বসে থাকো।

কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এর আগে আমার গোড়ালি মচকেছে। কিন্তু আমি যা করতে ভালোবাসি, বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় সেটা ছাড়া বাঁচি কেমন করে! এমনকি আমি পায়ের ওপর কোনো ওজনও নিতে পারতাম না। এক সপ্তাহ পর নিজেকে বোঝালাম, কেঁদে লাভ নাই। বরং সামনের দিকে তাকাই।
এই সময়ের মধ্যে আমার ইংরেজির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ফিজিও জর্ডানের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়েছে। তিনি তো আর সঙ্গে করে সাবটাইটেল নিয়ে আসতেন না! অতএব ডাবিংয়ের কোনো উপায় ছিল না। এই সময়টায় আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক ব্যথা সইতে হয়েছে। কিন্তু এই ব্যথা আমাকে আরও পরিপক্ব করেছে। নিজের শরীর, মন এবং ইংরেজি ক্রিয়াপদ আরও ভালো করে বুঝেছি।

হলুদ টি–শার্ট
এক মাস পর পায়ে ভার নিতে শুরু করলাম। এটা ছিল একটা বড় বিজয়। এর কিছুদিন পর হাঁটু ভাজ করতে পারলাম। আরেকটা বিজয়।
যখন বড়দের স্কোয়াডে যোগ দেওয়ার জন্য গত মার্চ মাসে তিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কী বলব। তিনি আমাকে টেক্সট পাঠিয়েছিলেন। বিশ্বাস করুন, ফিরতি মেসেজটা পাঠানোর আগে আমি ২০ বার পড়েছি। না জানি ভুলভাল কিছু লিখে ফেলি!
আমার প্রথম ম্যাচ ছিল মারাকানায়। যেন এক পরাবাস্তব মুহূর্ত! মনে আছে, ড্রেসিংরুমে ঢুকলাম, হলুদ রঙা টি–শার্টটা দেখলাম। পেছনে বড় করে লেখা, ‘মার্টিনেলি’। একটা ছবি তুলে বাবাকে পাঠালাম। বাবা লিখলেন, ‘দারুণ, খোকা।’
এটুকুই। কিন্তু আমি জানতাম, বাবা ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। যখন কথা হলো, তিনি প্রায় কেঁদেই ফেলছিলেন।
বিশ্বকাপে ডাক পাওয়ার পর আবার একটা জাদুকরি অনুভূতি হলো। এবার যখন আমার পরিবারের লোকজন বাড়ির পেছনের উঠানে এক হবে, আমিও থাকব সেখানে। তবে টিভির ভেতর। যদি সৃষ্টিকর্তা চান, ষষ্ঠ শিরোপা নিয়েই ফিরব।
বাবার সঙ্গে কথাবার্তা এখন আরও সহজ হয়েছে। অতীত নিয়ে কথা বলতে তিনি ভালোবাসেন। এই মৌসুমে লিগে আমি পাঁচটা গোল করেছি, তার মধ্যে দুটোই বাঁ পা দিয়ে। দুটি গোলের পরই বাবা ফোন করেছেন। বলেছেন, ‘মনে আছে, ছোটবেলায় যখন তোমাকে বাঁ পায়ে লাথি মারতে বলতাম, তুমি অভিযোগ করতে। এখন? সুফল পাচ্ছ তো?’
আমি আর কী বলব? তাঁর কথায় যুক্তি আছে। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনূদিত