অলি সাব সবাইকে বই পড়াতে চান। এ জন্য ‘৬৪ জেলায় বইপড়া আন্দোলন’ কর্মসূচিও শুরু করেছেন। সাইকেলে করে ঘুরছেন এক জেলা থেকে আরেক জেলা। সুনামগঞ্জের কলেজছাত্র অলির গল্প জানাচ্ছেন খলিল রহমান
অলি সাব?
জি, আমার নাম অলি সাব।
সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে থাকা অলি জানালেন, মা-বাবা চেয়েছিল বড় হয়ে ছেলে নামকরা মাওলানা হবে। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ওয়াজ করবে। লোকে তাঁকে ‘অলি সাব’ বলে ডাকবে। এ কারণে নামের সঙ্গে আগেই ‘সাব’ জুড়ে দিয়েছেন।
অলি সাবের বয়স এখন ১৯। কলেজে পড়েন। বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরী। বাবা লুৎফুর রহমান কৃষক, মা রোকেয়া বেগম গৃহিণী। চার ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ‘বইয়ের পোকা’ বলতে যা বোঝায়, অলি সাব তা–ই। সারাক্ষণ বই নিয়ে আছেন। বাড়িতে পাঠাগারও গড়েছেন। বিজ্ঞানী হতে চান অলি। বললেন, ‘বিজ্ঞান ভালো লাগে। বই পড়েই এই ভালো লাগার জন্ম। যেখানেই যাই, যাকেই পাই, বই নিয়ে কথা বলি। আমি বই পড়েই জীবন কাটাব।’
পড়াশোনার ফাঁকে অলি এখন বাইসাইকেল নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরছেন। মানুষকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করছেন। জানালেন, গত ৩ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে তাঁর ‘৬৪ জেলায় বইপড়া আন্দোলন’ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জে আসেন। পথে পথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগার, হাটবাজার, পাড়া-মহল্লায় নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করেন, বই উপহার দেন। ২০ অক্টোবর থেকে শুরু করেছেন কর্মসূচির দ্বিতীয় ধাপ। এবার নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ হয়ে অন্য জেলাগুলোতে যাবেন।
সাত বছর আগের কথা। কলম কিনতে এলাকার একটি বইয়ের দোকানে গিয়েছিলেন অলি। সেখানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী বইটি চোখে পড়ে। সেটি কিনে পড়া শুরু করেন। যতই পড়েন ততই তাঁর আগ্রহ বাড়ে। বিখ্যাত মানুষের জীবনী তাঁকে টানে। বই কিনতে এরপর একদিন জেলা শহরে যান। সৃজনশীল বই ও নানা পণ্যের দোকান ‘মধ্যবিত্ত’ থেকে বই কেনেন। দোকানটির মালিক মানবেন্দ্র করের সঙ্গে পরিচিত হন। মানবেন্দ্র নিজেও বইপাগল মানুষ। অলির বই পড়ার আগ্রহ দেখে উৎসাহ দেন। এরপর সময় হলেই আসতেন মানবেন্দ্রর কাছে। একপর্যায়ে শুধু বই পড়ার জন্য মধ্যবিত্ততে কাজ নেন অলি। তিন মাস ছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই পড়া ছিল তাঁর নেশা। দোকানে তো বটেই, দোকান থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন একটি করে বই নিয়ে যেতেন। একপর্যায়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, প্রথমা প্রকাশনের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অলির পরিচয় করিয়ে দেন মানবেন্দ্র কর। ঢাকায় গেলেই এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বই কেনেন অলি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে তাঁকে সম্প্রতি ৮৭টি বই উপহার দেওয়া হয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠান তাঁকে বই কেনায় বিশেষ ছাড়ও দিয়ে থাকে। অলি জানান, এ পর্যন্ত পাঁচ শর মতো বই পড়েছেন। বিজ্ঞান, ভ্রমণবিষয়ক বই তাঁর বেশি ভালো লাগে। ২০১৮ সালে নিজের বাড়িতে একটি পাঠাগার গড়ে তোলেন। তাতে এখন চার শর মতো বই আছে। পাঠাগারের নাম দিয়েছেন ‘স্বপ্নরাজ বুক ক্লাব’। এলাকার অনেকেই তাঁর পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়েন।
অলি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। সেসময় তাঁর বাবা বাইসাইকেল কিনে দেন। পরিকল্পনা করেন সাইকেলটি নিয়ে দেশ ঘুরতে বের হবেন। ৬৪ জেলায় ঘুরে মানুষকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করবেন। মা-বাবাকে ইচ্ছার কথা বলার পর কেউই রাজি হলেন না। এরপর একদিন নিজের কেনা বেশ কিছু বই নিয়ে আসেন মানবেন্দ্র করের কাছে। নিজের ইচ্ছার কথা জানান। অলির বইগুলো ১০ হাজার টাকায় কিনে নেন মানবেন্দ্র। এই টাকা দিয়েই ‘বই পড়ার আন্দোলন’ কর্মসূচি শুরু করেন অলি। এখন অবশ্য মা-বাবাকেও পাশে পেয়েছেন।
মানবেন্দ্র কর বললেন, ‘অলি আসলেই ব্যতিক্রম। এ রকম বইপড়ুয়া তরুণ আমি কমই দেখেছি। বই নিয়েই তাঁর সব ভাবনা। এখন বুঝতে পারছি, সে আমার এখানে মূলত বই পড়ার জন্যই কাজ নিয়েছিল। তাঁকে দেখে অন্যদের শেখার আছে।’