বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় বাংলাদেশের জান্নাতুল ফেরদৌস

‘উনি বললেন, বিবিসির হেডকোয়ার্টার থেকে বলছেন, আমি ভেবেছি নতুন কোনো প্রতারক চক্র’

জরিপের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকা তৈরি করেছে বিবিসি। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত সেই তালিকায় সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, লেবানিজ–ব্রিটিশ আইনজীবী আমাল ক্লুনিদের সঙ্গে উঠে এসেছে বাংলাদেশি নির্মাতা, লেখক ও প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী জান্নাতুল ফেরদৌস আইভির নাম। তিনি নিজে একজন বার্ন সারভাইভার। ১৯৯৭ সালে তিনি যখন স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী, তখন রান্না করতে গিয়ে ওড়নায় আগুন ধরে তাঁর শরীরের শতকরা ৬০ ভাগ পুড়ে যায়। মুখসহ শরীরের ওপরের অংশ পুড়ে কুঁচকে বিকৃত হয়ে গেলেও বেঁচে যান জান্নাতুল। এখন পর্যন্ত চামড়া প্রতিস্থাপনসহ প্রায় ৫০টি অস্ত্রোপচার লেগেছে তাঁর। তাতে থমকে গেলেও থামেনি জান্নাতুলের পথচলা। ভেতরের আগুনকে নিভে যেতে দেননি তিনি। নিজেকে বিকশিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণ, লেখালিখি, ছবি আঁকার মতো সৃজনশীল সব কাজ। প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ের জন্য গড়েছেন ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ নামের প্রতিষ্ঠান। জান্নাতুল ফেরদৌস–এর সঙ্গে কথা বললেন জিনাত শারমিন

বিবিসির প্রতিবেদনে জান্নাতুল ফেরদৌস
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
প্রশ্ন

অভিনন্দন, কেমন আছেন?

ভালো আছি। খুব হুলুস্থুলের ভেতর আছি। বিবিসির কাছে আগেই আমার সব তথ্য ছিল। কিছুদিন আগে ওরা আমাকে একটা ফরম পাঠায়। আমার সম্মতি নেয়। পুরো বিষয়টা জানায়। আমিও সেটা পূরণ করে জমা দিই। ওরা জানিয়েছিল যে ২১ তারিখে ওরা নিউজটা প্রকাশ করবে। এর আগে যেন না জানাই। আমি কাউকে কিচ্ছু বলিনি। এর আগেই দেখি বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে ফোন আসা শুরু হয়েছে। এদিকে আমি আবার বাসা বদলাচ্ছি। আমার বাসার সঙ্গেই অফিস। ফলে অফিসও শিফট হচ্ছে। এর ভেতর বিভিন্ন টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা বাসার ঠিকানা চাচ্ছেন। সাক্ষাৎকার নেবেন। কোন বাসার ঠিকানা দেব, বুঝতে পারছি না। ঠিকানা নাহয় দিলাম, এলে বসতে দেব কোথায়? কথাটা বলব কখন?

প্রশ্ন

বিবিসি কীভাবে আপনার সম্পর্কে জানল?

আমি জানি না। আমি অনেক ধরনের কাজ করি। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমার এনজিওর প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। নানাভাবে আমার মতো মানুষদের অধিকার আদায়ের পক্ষে লড়েছি। সিনেমার মাধ্যমে কথা বলেছি। হয়তো কোনো না কোনো মাধ্যমে ওদের কাছে আমার কোনো একটা প্রয়াস পৌঁছেছে। তারপর ওরা আমার সম্পর্কে জেনেছে, তথ্য জড়ো করেছে। আর আমার ধারণা লিংকডইন সাহায্য করেছে।

প্রশ্ন

প্রথম ফোনটা কবে এল?

২০–২১ দিন আগে। আমার আগের বাসার পাশে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। ভীষণ শব্দ হচ্ছিল। ওই সময় ফোনটা এল। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে। আমি ধরিনি। কেউ কারও কথা শুনতে পাব না। পরে শব্দ একটু কমলে আমি ব্যাক করলাম। ফোন গেল না। পরদিন আবার একই সময়ে একই নম্বর থেকে ফোন এল। বলল, ‘আমি বিবিসির হেডকোয়ার্টার থেকে বলছি। আপনাকে দুদিন আগে একটা মেইল করা হয়েছে। কোনো সাড়া না পেয়ে ফোন করলাম।’ আমি শুরুতে ভেবেছি, ফ্রড, স্প্যাম কল, নতুন কোনো প্রতারক চক্র! পরে মেইল চেক করলাম। উত্তর দিলাম। ওরা একটা হোয়্যাটসঅ্যাপ নম্বর দিয়েছিল। সেখানে যোগাযোগ করে নানা খুঁটিনাটি রিচেক করেছে।

জান্নাতুল ফেরদৌসের এই ছবি এখন কেবলই স্মৃতি
প্রশ্ন

২১ তারিখে কীভাবে সুসংবাদটা কীভাবে পেলেন?

আমি নিশ্চিত ছিলাম যে শেষ পর্যন্ত আমার হবে না। এ রকম কত জায়গায় আবেদন করি। কথাবার্তা হয়। ইন্টারভিউ হয়। শেষ পর্যন্ত হয় না। আর এখানে তো আমি আবেদনই করিনি। আর এত বড় একটা বিষয়, কত বড় বড় মানুষ এই তালিকায় থাকবেন, আমি তো তেমন কিছুই করিনি। সারা দিনে কোনো খবর নেই। সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে ফোন করে অভিনন্দন জানানো শুরু করল। অনেক রাতে, সবকিছু যখন থেমে গেছে, সবাই ঘুমে, রাত দুইটার পর আমি নিজে বিবিসির লিংকটা খুললাম। সেখানে আমার নিজের সম্পর্কে পড়লাম। অন্যদের সম্পর্কে পড়লাম। এত বছর সংগ্রামের পর, বহুবার বৈষম্যের শিকার হওয়ার পর, এত আওয়াজ তোলার পর অবশেষে এ রকম একটা রাত, এ রকম একটা স্বীকৃতি জীবন আমাকে দিল। জীবন অনেক কিছু কেড়ে নেয়। আবার কোনো না কোনো দিন, কোনো না কোনোভাবে ফিরিয়েও দেয়। এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।

লেখক, নির্মাতা ও মানবাধিকারকর্মী জান্নাতুল ফেরদৌস
প্রশ্ন

আপনার দুর্ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল?

১৯৯৭ সালের ৩০ এপ্রিল। কোরবানির ঈদের পরপর। ২৯ এপ্রিল বাবার কিছু বন্ধু এসেছিলেন বাসায়। আম্মু আমার ছোট ভাইকে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন। ওই দিন রাতে সবাই গল্পগুজব করে দেরি করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। আগের দিনের রান্না করা সব খাবার ছিল। সকালে আমিই খাবার গরম করতে গিয়েছিলাম। পরনে ছিল আম্মুর হাফ সিল্কের শাড়ি দিয়ে বানানো সালোয়ার–কামিজ। কীভাবে ওড়নায় আগুন লেগেছিল, বলতে পারব না। বোধ হয় ওড়না দিয়ে ধরে গরম পাতিল সরিয়েছিলাম। পেছন থেকে গরম লাগছিল। পেছনে তাকিয়ে সেটা কী বুঝে ওঠার আগেই আমার দুই হাত, গলা, মুখ পুড়ে শেষ। ভেতরে সুতির শেমিজ পরা ছিল বলে বেঁচে আছি।

প্রশ্ন

তারপর কী হলো?

প্রতিবেশীরা বললেন, (ঢাকার মগবাজারে) হলি ফ্যামিলিতে নিয়ে যেতে। তখন ঢাকা মেডিকেলে বার্ন ইউনিট ছিল না। সেখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিলাম। এখানে আমি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিমের কথা বলতে চাই। উনি যে কী যত্ন করে আমার চিকিৎসা করেছেন, কী পরিমাণ মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন, এর কোনো তুলনা হয় না। কয়েক মাস পর আমার শরীরের মাংস পচে গলে শুকিয়ে, চামড়া টেনে আমার থুতনি গলার সঙ্গে লেগে গেল। চোখের নিচের চামড়া টেনে চোখ নিচের দিকে নেমে ভয়াবহ অবস্থা। চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। কেবল গলায়ই আমার ১৭টা অপারেশন হয়েছে। ঘাড়ে নতুন চামড়া লাগানো হয়েছে। সেটা অ্যাডজাস্ট করেনি। আবার অপারেশন করে লাগানো হয়েছে। এভাবে মোট ৫১টা সার্জারি হয়েছে।

দুর্ঘটনার আগে দেখতে এরকম ছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস, তখন তিনি অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী
প্রশ্ন

পড়াশোনা কীভাবে করলেন?

এই দুর্ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এরপর তিন বছর চলে গেল চিকিৎসায়। এর ভেতর আমি অবশ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেসরকারি ব্যবস্থায় ডিগ্রি পরীক্ষা দিই। তারপর ইডেন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করি। আমার ছোট বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়ত। ওর সঙ্গে আইনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলব, তাই আমিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি ভর্তি হয়ে যাই। যদিও আমার আইন পড়তে ভালো লাগেনি। এত অপরাধ, তার আবার শাস্তির ধারা। অপরাধ না করলেই হয়! খুব মানসিক যন্ত্রণা লাগত। তবে আমি এলএলবি পাস করেছি। পরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে আরেকটা মাস্টার্স করি। এ ছাড়া তানভীর মোকাম্মেলের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করেছি। ডেইলি স্টারের চার মাসের সেলিব্রেটিং লাইফ কোর্সও করেছি। এটিও সিনেমার ওপর। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা কর্মশালা ও সেমিনারে অংশ নিয়েছি।

প্রশ্ন

চাকরি করেছেন তো?

হ্যাঁ। ২০০৫ সালের নভেম্বরে আমার মাস্টার্সের রেজাল্ট দেয়। ১ ডিসেম্বর থেকে আমার একটা ব্রিটিশ এনজিওতে চাকরি হয়। ওরাও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে। সে সময় ওদের তালিকাভুক্ত প্রায় ২০ হাজার প্রতিবন্ধী ছিলেন। অথচ তাঁদের একজনও বার্ন ভিকটিম নন! সব সময়ই আমার মতো বার্ন ভিকটিম নারীদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। ওখান থেকে আমি একটা এনজিওর বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ শিখেছি।

জান্নাতুল ফেরদৌসের গাছে ফুটেছে বেলি
প্রশ্ন

আপনার এনজিও যাত্রা শুরু করল কবে?

২০১০ সালের দিকে আমি চাকরি ছেড়ে দিই। নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করা শুরু করি। পলিসি মেকিং, ফান্ড রেইজিং থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ। ২০১৪ সাল থেকে আমার ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউস’ যাত্রা শুরু করে। ২০১৫ সালে আমরা রেজিস্ট্রেশন করতে পারি, লাইসেন্স পাই।

প্রশ্ন

আপনার লেখালিখির শুরু কীভাবে?

পড়াশুনার জন্য যেসব গাইড বই পড়তাম, সেগুলোর ভাষাও বাংলা, কিন্তু কিছুই বুঝতাম না। যেটুকু বুঝতাম, নিজের ভাষায় লিখতাম। সেগুলো লিখতে লিখতেই মনে হলো, আমি তো লিখতে পারি। লিখে নিজের ভেতর যা কিছু চলছে, সেগুলো প্রকাশ করতে পারি। লিখে ফেললাম আমার প্রথম উপন্যাস। আমি যখন প্রায় ৬০ শতাংশ পোড়া নিয়ে হাসপাতালে, আমার মধ্যবিত্ত পরিবারের সেই খরচ বহন করতে হিমশিম অবস্থা। হাসপাতালে আম্মু, মেজ খালা চিন্তিত মুখে বসে ছিলেন। তখন আমার নানা বলেছিলেন, ‘তোরা কোনো চিন্তা করিস না। আমার ভিটেটা তো আছে। বাড়ি বিক্রি করে আমি আমার নাতনির চিকিৎসা করাব। ওর কিচ্ছু হবে না। আমি আছি না?’ আমার উপন্যাসের একটা শক্তিশালী চরিত্র আমার নানা। আসলে ওই সময় আমার নানাবাড়ির সবাই খুব সাহায্য করেছেন। পাশে থেকেছেন। টাকাপয়সা দেওয়া, রক্ত জোগাড় করা, বাসায় গিয়ে রক্ত–পুঁজের কাপড় কেচে, ধুয়ে শুকিয়ে আবার হাসপাতালে নিয়ে আসা, মানসিকভাবে শক্তি দেওয়া—সবই করেছেন তাঁরা।

নিরবে জান্নাতুল ফেসদৌস পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এখন চলছে নক্ষত্রের প্রি–প্রোডাকশন
প্রশ্ন

আপনি মানবাধিকারকর্মী, সিনেমা বানান, ছবি আঁকেন, কবিতা–উপন্যাস লেখেন, ঢাকা শহরের এতটুকু বারান্দায়ই চাষাবাদ করেন, আপনার বাকেট লিস্ট বা উইশ লিস্টে আর কী কী আছে?

আমি এভাবেই কাজ করে যেতে চাই। আমার মতো যাঁরা, তাঁদের জন্য রাস্তা তৈরি করে দিতে চাই, যাতে এই পথটুকু চলতে আমাকে যতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে, তাঁদের যেন আরেকটু হলেও সহজ হয়। বার্ন ভিকটিম নারীরা যে কী অমানবিক জীবন যাপন করেন, কী বৈষম্যের ভেতর দিয়ে যান, এর কোনো সীমা নেই! তাদের জীবনে একটু ইতিবাচকতা আনার চেয়ে আর কোনো কিছুই আমার কাছে বড় নয়। আর আমি চাই, আমাকে যেন বাংলাদেশের প্রথম ডিজঅ্যাবল নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটার জন্য কি তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে, না সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে, প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে হবে নাকি বিবিসির এই প্রতিবেদনের মতো এমনি এমনিই হবে, আমি আসলে জানি না। তবে বেঁচে থাকতে আমি এই স্বীকৃতি চাই।