বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। অনেক ঈদে ছুটি পেতেন না। তারপরও খুশি ছিলেন, মানুষের সেবা করে ঈদটা কাটবে বলে। বাবার এই মহানুভবতা স্পর্শ করে ছেলে সৌমিক আহমেদকে। তিনিও মানুষের সেবা করতে চান। অন্যদিকে বাবার চাওয়া ছিল, ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে। দুজনের চাওয়াই যখন এক, সৌমিক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ হতে না হতেই বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করেন। সৌমিক বলেন, ‘পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বড় ভাই টেক্সটাইল সেক্টরে আছেন, আরেক ভাই এনজিওতে চাকরি করেন। বোনদের মধ্যে একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, অন্যজন গৃহিণী। ভাই-বোনদের মধ্যে কেউ বিসিএস ক্যাডার নেই। তাই বাবা সব সময় চাইতেন, আমি যেন বিসিএস ক্যাডার হই।’
বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ৪১তম বিসিএস ছিল সৌমিকের প্রথম বিসিএস। তাতে অংশ নিয়েই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডারের সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) পদে প্রথম হয়েছেন। সৌমিকের এই সাফল্যের পেছনে তাঁর প্রস্তুতির ধরনটাও ছিল চমকপ্রদ। আগে বিসিএস প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে টিউশনি করতেন। যখন চাকরি পেলেন, টিউশনি ছেড়ে দিলেন। এরপর চলতে থাকল চাকরির পাশাপাশি প্রস্তুতি। সৌমিক বলেন, ‘অফিসে যাওয়ার আগে এক ঘণ্টা পড়তাম। অফিস থেকে ফিরে আবার রাত ১২টা পর্যন্ত পড়তাম। প্রচুর শর্ট নোট নিতাম। দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা (লংটাইম প্ল্যান) বানাতাম। দেখা যেত, ২০-৩০ দিনের একটা পরিকল্পনা থাকত, সেটা অল্প সময়ে সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করতাম। পরদিন কী পড়ব, আগের দিন রাতে ঠিক করে রাখতাম। আমি সব সময় চেষ্টা করতাম, রুটিনমাফিক কাজ করতে। মাথায় রাখতাম, যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক, আমাকে রুটিন শেষ করতে হবে।’
যেদিন ফল বের হয়, তার দুই দিন আগে নতুন কর্মস্থল বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষে (বেপজা) যোগ দিয়েছিলেন সৌমিক। অফিস থেকে ফিরেই ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন। ল্যাপটপ, মুঠোফোন—দুটোই দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এরপর মাগরিবের আজান যখন দিল, সৌমিক ভাবলেন, আজ হয়তো আর ফল দেবে না। নামাজে চলে যান তিনি। নামাজ থেকে ফেরার পথেই ফল প্রকাশের খবর পান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুরুতে ফল দেখে মনে হচ্ছিল, কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। বাসায় গিয়ে প্রবেশপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হন। হ্যাঁ! জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডারের তালিকায় প্রথম রোলটিই তাঁর। সেই সময়ের অনুভূতি প্রসঙ্গে সৌমিক বলেন, ‘প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বন্ধু-বান্ধব, আম্মু–আব্বু সবাইকে ফোন করে জানাই। তাঁরা অনেক খুশি হন। তাঁদের খুশিতে আমিও অনেক খুশি।’
প্রকৌশল ক্যাডারের মধ্যে জনস্বাস্থ্যই প্রথম পছন্দ ছিল বলে জানান সৌমিক। বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল মূলত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিয়ে কাজ করে। বিশুদ্ধপানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যাপারটি তারা দেখে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে এসব কাজের প্রতিই আমার আগ্রহ ছিল।’
সামনে যাঁরা বিসিএস পরীক্ষা দেবেন, তাঁদের জন্য সৌমিকের পরামর্শ—বিসিএস দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। অবশ্যই প্ল্যান বি, প্ল্যান সি থাকতে হবে। এখানে ধারাবাহিকতা ও লেগে থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সৌমিক সতর্কও করে দিলেন, খুব বেশি প্যাশন বা ডেডিকেশন না থাকলে বিসিএসের চেষ্টা করা উচিত নয়। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি এই যাত্রার ধকল অনেকেই সহ্য করতে পারেন না। তখন হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না।
সৌমিক নিজেও বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য ধরে এগোননি। সঙ্গে অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতি নিয়েছেন। সফলও হয়েছেন। প্রস্তুতির দুই বছরের মাথায় নিয়োগ পান অডিট অফিসে, অডিটর হিসেবে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরে। এরপর বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে। শেষ বেপজাতে আছেন কাউন্সিলর কাম ইন্সপেক্টর (এনভায়রনমেন্ট) হিসেবে।
সৌমিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন পার করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানকার সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী তিনি। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগ নিয়ে মেতে থেকেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন কাজ করেছেন। এই অভ্যাসই সবচেয়ে কাজে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। সৌমিক বলেন, ‘আমরা বন্ধুরা কয়েকজন মিলে নোট করতাম, নোট শেয়ার করতাম, একে অন্যকে সাহায্য করতাম। এই সহযোগিতাটা খুব বেশি কাজে এসেছে। বিশেষ করে, আমাদের টেকনিক্যাল পড়াশোনায়।’
মাঝখানে দুই বছরের জন্য বেকার ছিলেন এই তরুণ। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে সৌমিক বলেন, ‘পড়াশোনা শেষে বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই চাকরি পায়। অনেকে অনেক জায়গায় ভালো করছিল। আমি টিউশনি করতাম, চাকরির দেখা তখনো পাইনি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা যখন জিজ্ঞেস করত, “কী করছ?” কিছু বলতে পারতাম না। চাকরি যখন হলো, অফিস থেকে এসে নিয়মিত পড়াশোনা, অফিসে যাওয়া, পরীক্ষার সময় ছুটি নেওয়া—এসব কঠিন ছিল। বাড়িতে ঠিকমতো যাওয়া হতো না। শুক্রবারগুলোয় পরীক্ষা দিতাম। বাকি দিনগুলো অফিস বা টিউশনি করতাম।’
দিন শেষে দারুণ খুশি সৌমিক, ‘আমি সব সময় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। এর ৬ নম্বর লক্ষ্যটি হলো, নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনসেবা। বাংলাদেশের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এটা নিয়ে কাজ করতে চাই। কাজের মাধ্যমে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন করতে চাই,’ বলেন সৌমিক।