২০২৩ সালজুড়ে উত্থান-পতনের একটা ঝড় বয়ে গেছে। নানা অকল্পনীয় পরিবর্তন আমরা দেখেছি। ওপেন এআইয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত টুল চ্যাটজিপিটির পেছনে মাইক্রোসফট ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে, কিংবা ইলন মাস্ক টুইটারের লোগো থেকে ল্যারি নামের নীল পাখিটিকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে—এ রকম খবরগুলো সব খাতের মানুষকেই ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সে শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা, ডিজিটাল কনটেন্টনির্মাতা, প্রোগ্রামার…যে-ই হোক।
করোনার মহামারি শেষে যখন আমরা একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলব ভেবেছি, তখনই সরকারি সংস্থা, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, সবাই মিলে পড়ালেখার ধরন, পাঠ্যক্রম, মূল্যায়নের তরিকা ইত্যাদি হালনাগাদ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। কারণ, ভবিষ্যতের দিকে নজর দিতে হলে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের তৈরি করতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটা গ্রাম ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর জন্য তৈরি হতে হলে আমাদের ছেলেমেয়েদের যত বিস্তৃত জ্ঞান থাকা দরকার, সেই তুলনায় নবম-দশম শ্রেণির আইসিটি পাঠ্যক্রম অনেকটাই পিছিয়ে।
জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত যে বইটি বাধ্যতামূলক করেছে, সেটি ২০১৫ সালে প্রকাশের পর ২০২২ সালে নতুন করে ছাপানো হয়েছে। সিলেবাস দেখে এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এই বইতে অ্যালগরিদম, ডেটা রিপ্রেজেন্টেশন, লজিক, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কিংবা সমস্যা সমাধানের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর কোনো ধারণা নেই। বরং উদ্ভাবকদের ইতিহাস, বাংলাদেশে আইসিটি শিক্ষার ভূমিকা, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, ডেটাবেজ ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ল্যাবে চর্চা করার জন্য বিষয়গুলো ভালো, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট কি?
শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সফটওয়্যার ও অ্যাপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠ্যক্রমে আইসিটি বিষয়টি একটা বড় সুযোগ। তবে কম্পিউটার বিজ্ঞান মূলত সক্ষমতা তৈরিতে সাহায্য করে। শিক্ষার্থীদের শেখায় কীভাবে সফটওয়্যার ও অ্যাপ তৈরি করতে হয়। ছেলেবেলা থেকেই এই জ্ঞান থাকাটা সমস্যা সমাধান ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার দক্ষতা তৈরিতে সহায়ক। এটা তাদের ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের জন্য তৈরি করবে, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটাবে। ওরা জানবে, এসব জটিল প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে। দক্ষতার ঘাটতি পূরণে উদ্যোগী হবে, নানা ধরনের কাজের সুযোগ সম্পর্কে জানবে, এমনকি উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন উদ্যোগেও তারা আগ্রহী হতে পারে।
ডিজিটাল সাক্ষরতা খুবই জরুরি। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানের সঙ্গে এর সম্পর্ককে আমরা ছোট করে দেখতে পারি না। তবে নবম দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যা পড়ানো হচ্ছে, তা বিষয় হিসেবে ভালো হলেও আরও ছোট ক্লাসের জন্য উপযোগী।
উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই নিয়েও নতুন করে ভাবার সুযোগ আছে। যেখানে ব্রিটিশ পাঠ্যক্রম অনুযায়ী নবম, দশম কিংবা তার চেয়ে নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও পাইথন কোডিং, সি-শার্প, জাভা স্ক্রিপ্টিংয়ের মতো বিষয় শেখে, সেখানে আমরা উচ্চমাধ্যমিকেও এখনো সি আর এইচটিএমএলের মতো প্রোগ্রামিং ভাষায় আটকে আছি।
যারা স্কুলে, কলেজে কিংবা ভবিষ্যতে আরও পড়ালেখা করবে, কম্পিউটার দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা এখন আর শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন দৈনন্দিন জীবনের জন্যই জরুরি। শিক্ষার্থীরা একদম ছেলেবেলা থেকে শেখা শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই একেক শ্রেণিতে পর্যায়ক্রমে তারা আরও বড় পরিসরে শেখার সুযোগ পাবে। শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দেওয়ার জন্য যথার্থ সিলেবাস যদি না থাকে, আমরা যদি ক্রমান্বয়ে তাদের জ্ঞান উন্নীত করতে না পারি, তাহলে আদতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক সেবা দিতে ব্যর্থ হব। কম্পিউটার বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, ডিজিটাল সাক্ষরতা, সবকিছুকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসতে হবে। যেন প্রযুক্তির শক্তিটা তারা অনুধাবন করতে পারে। প্রি-স্কুলে যেভাবে বাংলা বা ইংরেজি ভাষা শেখানো হয়, আইসিটির পাঠ্যক্রম নিয়েও সেভাবেই ভাবতে হবে। ৫ বছর আগে প্রযুক্তি খাতে কী ঘটেছিল, আজ ওসব সেকেলে হয়ে গেছে। আমাদের আশপাশে, ক্লাসরুমের বাইরে যে পরিবর্তন আমরা এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, আইসিটির পাঠ্যক্রমে কেন তার প্রতিফলন থাকবে না?
লেখক: ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্ক ফর একাডেমিক ইনটিগ্রিটির (ইরাসমাস+) নির্বাচিত বোর্ড মেম্বার এবং দুবাইয়ের ইউনিভার্সিটি অব ওলংগংয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সেস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক