সাফজয়ী ফুটবলার ইয়ারজান বেগমের মা রেনু বেগম
সাফজয়ী ফুটবলার ইয়ারজান বেগমের মা রেনু বেগম

সাফজয়ী মেয়েকে মাঠে টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করে চলেছেন এই দিনমজুর মা

নেপালে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতের তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছেন ইয়ারজান বেগম। তাঁর সেই কৃতিত্বেই না শিরোপা জিতল বাংলাদেশ। অথচ ইয়ারজানকে ফুটবল মাঠে টিকিয়ে রাখতে এখনো সংগ্রাম করে চলেছেন তাঁর দিনমজুর মা। রাজিউর রহমানকে সেই লড়াইয়ের গল্পই বলেছেন রেনু বেগম

মানুষের খেতে–খামারে একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত জোটে না। তাই কখনো টমেটোখেতে নিড়ানি দিই, কখনো মরিচ তুলি, আবার ধানের মৌসুম আসলে চারা বুনি। সব কাজই এখন শিইখা গেছি।

রোববার (১০ মার্চ) সকালেও কাজে বের হইছিলাম। বাদামখেতে নিড়ানির কাজ। সেই কাজ করতে করতে বিকাল শেষ। নেপালে ইয়ারজানের খেলা চলে জানি, কিন্তু সেদিন খেলা আছিল জানতাম না। বাড়িতে ঢুইকা দেখি হইচই। আমাদের টাচফোন (স্মার্টফোন) নাই। কার জানি টাচফোন জোগাড় কইরা বাড়ির সবাইকে নিয়ে উঠানে বইসা খেলা দেখতেছে ইয়ারজানের বাপ। খেলা দেখতেছে আর চিৎকার দিতেছে। আমি তো বুঝি না ঘটনা কী। কাছে গিয়া শুনি ইয়ারজান তিনটা গোল আটকাইয়া দিছে। ওরা নাকি জিইতাও গেছে। শুইনা আনন্দে আমার চোখে পানি চইলা আইছে। মেয়েটার সাথে কথা কইতে খুব মন চাইল। কিন্তু সে তো নেপাল, কথা কমু কেমনে?

পাড়া–প্রতিবেশী সবার আনন্দ দেখে সারা দিনের কষ্ট ভুইলা যাই। আমার দেবরেরা চাল তোলা শুরু করে। গ্রামবাসী কয়েকজন মিইলা চাল-ডাল আর মুরগি কিনি আনল। তারা বাড়িতে খিচুড়ি রানল। খায়াদায়া আনন্দ করল। রাতে মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমাইলাম। পরের দিন মেয়ে দেশে ফিরবে শুনছি। আমরা মোবাইল হাতে নিয়া অপেক্ষা করতে থাকি। সোমবার বিকাল তিনটার দিকে ইয়ারজান ফোন করল, ‘আম্মু, আমি দেশে আসছি। তুমি দোয়া করো।’

এটুকুই। পরে আর কথা হয় নাই।

নেপালে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতের তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছেন ইয়ারজান বেগম

আমার শাশুড়ি নাম রাখলেন ইয়ারজান

১৮ বছর আগে আমার বিয়ে হয়। ইয়ারজানের বাপের (আবদুর রাজ্জাক) নাকি বিয়ের আগে একবার টিবি (যক্ষ্মা) হইছিল। চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়া গেছে। বিয়ের পর দেখতাম সে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। ভালোই চলত সংসার। দুই বছরের মাথায় একটা মেয়ে হইল। শাশুড়ি নাম রাখল ইয়ারজান বেগম। সংসারের খরচ বাড়ল। বাড়তি রোজগারের আশায় ঢাকায় গেল ওর বাপ। সবকিছু ভালোই ছিল। হঠাৎ করে আবারও টিবি দেখা দিল। বাড়িতে চইলা আসল ইয়ারজানের বাপ। ইয়ারজান তখন কেবল হাঁটা শিখছে। উপায় না পায়া আমাকেই সংসারের হাল ধরতে হইল।

বাড়িতে অসুস্থ স্বামী আর ছোট্ট মেয়েকে রাইখা অন্যের খেতখামারে কাজ করা শুরু করলাম। দৈনিক হাজিরা ২০ টাকা। তা দিয়াই কোনোমতে সংসার চালাইতে হতো।  ধীরে ধীরে ইয়ারজান বড় হইতে ছিল। ৫-৬ বছর বয়স থেকেই ইয়ারজানের বল খেলার প্রতি ঝোঁক। পুরান প্লাস্টিক (পলিথিন) জড়ো কইরা ওকে বল বানায়া দিতাম। সেইটা দিয়াই সে আশপাশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলত। একদিন বাপের কাছে বায়না ধরল, বল কিনি দেও। অনেক কষ্টে একটা বল কিইনা দিল ওর বাপ। এরপর যখন প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া শুরু করল, সেইখানেও সে স্কুলে খেলাধুলা করত। কাজে যাওয়ার কারণে বেশি খোঁজখবর নিতে পারতাম না। ইয়ারজান যখন হাইস্কুলে (হাঁড়িভাসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়) ভর্তি হইল, তখন স্কুল থেকে সব খেলাতেই নাম লেখাইত। অভাবের সংসার। কোনো দিন খায়া, কোনো দিন না খায়া স্কুলে যাইত। কিন্তু পেটে ক্ষুধা থাকলেও খেলা থাইকা দূরে থাকে নাই। স্কুলে পড়ার সময় মাঝেমধ্যেই মেডেল নিয়ে বাড়ি আসত। আমি এসবের গুরুত্বও বুঝতাম না।

মেয়ে ইয়ারজানের ট্রফি হাতে মা রেনু বেগম ও বাবা আবদুর রাজ্জাক

আপনার মেয়ে তো ভালো ফুটবল খেলে?

ইয়ারজান যেখানেই যায়, সেইখান থাইকাই জিতে আসে। এই খবরটা পঞ্চগড় শহরের টুকু রেহমান পাইছিলেন। বাড়িতে আইসা তিনি কইলেন, আপনার মেয়ে তো ভালো খেলে। ওকে আমার একাডেমিতে দেন, খেলা শিখাব। তখন তো অত কিছু বুঝি না। কইলাম, আমাদের টাকাপয়সা নাই, এত দূরে গিয়ে কীভাবে খেলা শিখব। টুকু রেহমান কইলেন, আগে পাঠানো শুরু করেন। যেদিন টাকা থাকবে না, আমরা চালিয়ে নিব।

এরপর থাইকাই ইয়ারজান প্রতিদিন বিকেলে পঞ্চগড়ের (বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম) স্টেডিয়ামে গিয়া খেলত। বাড়ি থাইকা প্রায় ১২ কিলোমিটার। কোনো দিন স্কুল থাইকা আইসা না খাইয়াই চইলা যাইত। আমি তখন ২৫০ টাকা হাজিরায় মানুষের কাজ করি। সেই টাকা থাইকা ৫০ থেকে ৬০ টাকা মেয়েকে ভ্যানভাড়া দিতে হয়। বাকি টাকা দিয়া সংসার চালাইতে হয়। যেদিন টাকা থাকত না, কোনো রকম শুধু যাওয়ার ভাড়াটা দিতাম। ফেরার টাকা না থাকলে টুকু রেহমান কোনো দিন দিতেন, কোনো দিন আবার নিজেই বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতেন। 

কী করব কোনো কূলকিনারা পাই না

মেয়ে শহরে যাইয়া ফুটবল খেলে দেখে এলাকার নানা মানুষ নানা রকম টিটকারি করত। কেউ কইত, বিয়া দিবার খবর নাই, ইনকাম খাবার আশায় খেলায় পাঠায়। কখনো মানুষ কইত, মায়ে কাজ করে, বাপে কাজ করতে পারে না আর মেয়ে খেলায় বেড়ায়। কিন্তু আমি কোনো দিন কারও কথা ঘুরায় (উত্তর) দেই নাই। মানুষ বললে তো আর তাদের মুখ বন্ধ করার ক্ষমতা আমার নাই। তারপরও অনেক সময় রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবি, মেয়েটা আমার বড় হচ্ছে, আজকে না হয় দুই বছর পরও তো বিয়া দিতে হইবো। একদিকে অসুস্থ স্বামী, কোলে সাড়ে তিন বছরের আর একটা মেয়ে। আবার বাড়িঘর ভাইঙ্গা পইড়া আছে। কী করব কোনো কূলকিনারা পাই না।

এবারও ঢাকায় পাঠাইছি ধারদেনা করে 

এভাবে নানা খেলায় সে ভালো করে। আমি তো বুঝি না অত কিছু। পঞ্চগড়ে খেলে, ঢাকায় খেলে। মেয়ে আমার স্বপ্নের কথা বলে। এ জন্য ওর বাবা অবশ্য মেয়েকে কোনো দিন বাধা দেয় নাই। আমিও বুইঝা গেছি মেয়েটাকে আটাকায়া লাভ নাই। 

গত বছর ইয়ারজান খেলার জন্য ঢাকায় (উইমেনস প্রিমিয়ার লিগের ট্রায়ালে) গেছিল। বাড়ি ফিইরা আইসা কইছিল, (বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের) অফিসাররা তাকে পছন্দ করছে। সেখানে তাকে বলছে, তুমি বাড়ি যাও, পরে তোমাকে ডাকা হবে।

সেই ডাক আসে তিন মাস আগে। ইয়ারজান একদিন কইলো, মা আমি ঢাকা যাব, (মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ ফুটবলের ট্রায়ালে) ডাক পড়ছে। আমি পড়লাম অকূল পাথারে। আমার কাছে তো টাকা নাই। মেয়েকে পাঠাই কী কইরা। পরে হাওলাত করে পঁচিশ শ টাকা জোগাড় কইরা মেয়ের হাতে তুইলা দিই। সেই টাকা নিয়া সে ঢাকা গেছে। টাকা ধার কইরা পাঠানো মেয়েটা যে পরে সারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করব, তখন ভাবতেও পারি নাই।