নিজের মৃত্যুসনদ নিজেই ফেরত দিয়ে এলাম

গভীর সাগরে মাছ ধরতে ধরতেই ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কবলে পড়ে মাছ ধরার ট্রলারটি। প্রবল ঢেউয়ে ট্রলারে পানি জমে যায়, সেই পানি সেচতে গিয়েই আচমকা ঢেউয়ের তোড়ে উত্তাল সাগরে ছিটকে পড়েন হরনাথ দাশ। তারপর নোনাজলে বেঁচে থাকার চেষ্টা। সবাই যখন ধরে নিয়েছে হরনাথ আর নেই, তখনই জানা যায়, ভাসতে ভাসতে ভারত থেকে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। বেঁচে ফিরে আসার অবিশ্বাস্য সেই গল্পই শুনে এসে অনুলিখন করলেন এস এম হানিফ

বেঁচে ফেরাটা হরনাথ দাশের কাছেও অবিশ্বাস্য মনে হয়

কক্সবাজারের চকরিয়ায় আমার বাড়ি হলেও বছরের অর্ধেক সময় কাটে দুবলার চর এলাকায়। চরের শুঁটকিপল্লির মহাজন আবু বহরদারের সঙ্গে আমি আর আমার বড় ছেলে পলাশ দাশ কাজ করি। মহাজনের মাছ ধরার ট্রলার মোহনা-২ নিয়ে এই সময় সাগরে মাছ ধরা হয়। আমি এই ট্রলারে ইঞ্জিনরুমের দায়িত্ব পালন করি। অন্য ট্রলারে থাকে পলাশ।

পাঁচ মাস থাকার প্রস্তুতি নিয়ে এবার আমরা দুবলার চরে যাই গত ৭ নভেম্বর। তার দুই দিন পর দিন দশেকের পানি, চাল-ডাল, তরিতরকারিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে বের হই। সেদিন আট ঘণ্টা ট্রলার চলে। বিকেল চারটার দিকে পৌঁছাই গভীর সাগরে। আগে কখনো সাগরের এই এলাকায় আমরা মাছ ধরিনি। বেশ গভীর মনে হয় জায়গাটা। সেখানেই বিকেলে জাল ফেলি।

নিয়ম করে জাল ফেলা আর মাছ ধরা—এভাবেই চলতে থাকে সাগরের দিন। জাল ফেলে তিনটি ট্রলার নিয়ে আমরা কাছাকাছি থাকি, গল্পগুজব করি।

দুবলার চরের শুঁটকিপল্লি

এত বড় ঢেউ কখনো দেখিনি

১৬ নভেম্বর বিকেলে হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করে। সাগরও উত্তাল হয়। সাগরের এমন আচরণ আগেও দেখেছি। প্রথমে আমরা অত পাত্তা দিইনি। যে যাঁর কাজ করি। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকে সমুদ্রের ঢেউ। ৫২ বছরের জীবনে সাগরে মাছ ধরি ২০ বছর ধরে। কিন্তু এত উঁচু ঢেউ কখনো দেখিনি।

একপর্যায়ে নোঙর ছিঁড়ে ট্রলারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি আমরা। অন্য দুটি ট্রলার ভেসে যায় দূরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সমুদ্রের স্রোত যেদিকে, সেদিকে ট্রলার যেতে থাকে। ভয়ংকর একটা রাত কাটে।

১৭ নভেম্বর ভোরেও প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে দুলতে থাকে ট্রলার। ভেতরে পানি ঢোকে। আমি ট্রলার থেকে পানি সেচে ফেলার চেষ্টা করি। সকাল ১০টার দিকে আমাদের ট্রলারে হাঁটুসমান পানি হয়। পানি সেচতে থাকি আমি। এমন সময় উঁচু একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় সমুদ্রে ছিটকে পড়ে যাই। পড়তেই আরেকটা ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারের কাছ থেকে চলে যাই দূরে।

উত্তাল বঙ্গোপসাগর

কাঁকড়া কামড় বসায় হাতে-পায়ে

ট্রলারে আমরা ১৮ জন ছিলাম। অন্যরা ট্রলার থেকে নানাভাবে চেষ্টা করেন আমাকে তুলে নিতে। দূর থেকে দেখি, কিন্তু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণহীন ট্রলারটা নিয়ে কাছে আসতে পারেন না। তখন একটি প্লাস্টিকের ড্রাম তাঁরা সমুদ্রে ফেলে দেন। একসময় ড্রামটা নাগালে পাই। সেটি ধরেই ভাসতে থাকি।

মাঝসমুদ্রে আমি একা। সারা দিন প্রবল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। কোথাও কোনো ট্রলারের দেখা নেই। রাত বাড়তে থাকলে মনোবল হারিয়ে ফেলি। সারা দিন কিছু খাইনি, খিদে পায় প্রচুর।

১৮ নভেম্বর ভোরের আলো ফোটে। মনে আবার আশা জাগে, আজ হয়তো আমাকে কেউ উদ্ধার করবেন। আবারও সারা দিন ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ চলে। হাতে-পায়ে কাঁকড়া এসে কামড় বসায়। বহু কষ্টে কাঁকড়াগুলো ছাড়িয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করি। পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ। পেটে কিছুই নেই। খিদের যন্ত্রণায় শরীরটা আর চলে না। বাধ্য হয়ে নোনাজল খাই।

সন্ধ্যার পর ঢেউয়ের উচ্চতা কমে আসে। রাতে ভাসতে ভাসতে এক জায়গায় চারটি বাঁশ ও একটি কলাগাছ ভাসতে দেখি। বাঁশ চারটি দড়ি দিয়ে বাঁধা। ড্রামে ভর রেখে বাঁশগুলো নিচে দিয়ে ওপরে কলাগাছ রেখে ভেলার মতো করে বানাই। তার ওপর বসে শ্বাস নিই।

এই দুই দিনে একবারের জন্যও ঘুমাইনি। ভেলায় উঠে পড়তেই চোখ বুজে আসে। ততক্ষণে নোনাজল খেয়ে খেয়ে পেটের অবস্থা খারাপ। ১৯ নভেম্বর ভোর থেকেই শুরু হয় পাতলা পায়খানা আর বমি। কয়েকবার বমি করার পর শরীরের শক্তি একেবারে শেষ হয়ে যায়। ভেলার ওপর বসে ভগবানকে ডাকতে থাকি।

ভেলা চলছে শান্ত সাগরে। কূল-কিনারা নেই। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর। এমন সময় একটি সিগন্যাল বাতি ভেসে এসে ভেলার সঙ্গে ধাক্কা খায়। সিগন্যাল বাতিটি তখনো মিটিমিটি জ্বলছিল। বাতিটি নিয়ে ড্রামের সঙ্গে বাঁধি। দীর্ঘদিন সাগরে মাছ ধরতে এসে এটা বুঝে গেছি—এই বাতি দেখলে বড় কোনো জাহাজ গায়ের ওপর দিয়ে যাবে না। আবার কোনো ট্রলার পাশ দিয়ে গেলে অন্তত ফিরে তাকাবে।

কখন যেন রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ধপাস করে ভেলা থেকে পানিতে পড়ে গিয়ে ঘুম ভাঙে। ভেলাটি ধরে রাখার শক্তি নেই। এই প্রথমবার মনে হলো, আর হয়তো বাঁচব না। ড্রামে থাকা দড়িটা দিয়ে বাঁ হাত বেঁধে ফেলি—মারা গেলেও দেহটা যেন ডুবে না যায়, কেউ আমার লাশটি যেন খুঁজে পায়।

বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধানে হরনাথ দাশ

কারা যেন ডাকছে

২০ নভেম্বর। হয়তো গভীর রাত তখন। আচমকা ডাকাডাকি শুনে চোখ মেলে দেখি, কিছু মানুষ হিন্দিতে কথা বলছেন। বুঝতে পারি, ভারতীয় জেলে তাঁরা। হয়তো আমার ড্রামে বাঁধা সিগন্যাল বাতি দেখে ট্রলার নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমার তো কথা বলারও শক্তি নেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি তাঁদের দিকে। তাঁরা আমার শারীরিক অবস্থা বুঝতে পেরে ট্রলারে তুলে নেন। এরপর গরম পানি করে গোসল করিয়ে কম্বল মুড়িয়ে দেন। ভাতের মাড়, দুধ, কিশমিশ ও বাদাম খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার তো মুখ হাঁ করারও শক্তি নেই তখন।

২১ নভেম্বর সকালের দিকে জেলেরা ভারতীয় কোস্টগার্ডকে আমাকে উদ্ধারের কথা জানান। অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতীয় কোস্টগার্ডের হেলিকপ্টার আসে আমাকে নিতে। কিন্তু দড়ি ধরে হেলিকপ্টারে ওঠার শক্তি নেই বুঝতে পেরে ফিরে যায়। এরপর জাহাজ এসে আমাকে ট্রলার থেকে নিয়ে যায়। এর পরের দুদিন ভারতীয় কোস্টগার্ডের সেবায় আমি একটু সুস্থ হয়ে উঠি। ২৪ নভেম্বর বিকেলে আমাকে তারা বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের কাছে তুলে দেয়।

চট্টগ্রামে বাস থেকে নামার পর—ছেলে সিকদার দাশের সঙ্গে বাবা হরনাথ দাশ

সাগরে আর যাব না

বাংলাদেশ কোস্টগার্ড আমাকে মোংলার ইউএনওর কাছে তুলে দেয়। তিনি আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২৫ নভেম্বর বাসে তুলে দেন। চট্টগ্রামের বাস কাউন্টার থেকে আমার ছোট ছেলে সিকদার দাশ গিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। বাড়ি এসে জানতে পারি, ট্রলারের অন্যদের কাছে বর্ণনা শুনে সবাই ধরে নিয়েছিল আমি মারা গেছি। আমার বড় ছেলে বাড়িতে সেই দুর্ঘটনার খবর জানায়। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাই মৃত্যুসনদও নিয়ে আসা হয়েছে। সনদটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। নিজের মৃত্যুসনদ নিজেই গিয়ে ফেরত দিয়ে এসেছি।

এখনো আমার শরীরে তেমন বল নেই। সারা শরীরে কাঁকড়ার কামড়ের অসহনীয় ব্যথা। নড়তে পারি না। নোনাপানি খেয়ে পাইলসও বেড়েছে। চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্যও নেই। এদিকে ঘরে নেই খাবার। তারপরও আমি আর সাগরে যাব না।