নওগাঁর এই মাটির বাড়িটি দেখতে যান অনেক দর্শনার্থী
নওগাঁর এই মাটির বাড়িটি দেখতে যান অনেক দর্শনার্থী

নওগাঁর এই মাটির দোতলা বাড়িতে আছে ১০৮টি ঘর

নওগাঁর চারদিকে এখনো অনেক মাটির বাড়ি চোখে পড়ে। কোনোটা একতলা, কোনোটাবা দোতলা। তেমনই একটি দোতলা বাড়ির কথা আজ আপনাদের বলব। প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো এই মাটির বাড়িতে ১০৮টি ঘর আছে, সেগুলোতে বাস করে অনেকগুলো পরিবার। বাড়িটি ঘুরে এসেছেন এম এ হান্নান

নওগাঁ বাসস্ট্যান্ড থেকে মহাদেবপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বাসে তেরমাইল মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বা ভ্যানে চেপে দুপাশে সবুজের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পিচঢালা পথে ফুরফুরে বাতাস খেতে খেতে পৌঁছে যাবেন আলীপুর। মূল রাস্তায় নেমে হাতের ডানে ইটগাঁথা রাস্তা পেরিয়ে ডান পাশে পুকুর রেখে এগিয়ে গেলেই সেই মাটির ঘর। ১০৮ ঘরের দোতলা বাড়িটি দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসেন মানুষ। শীতের দিনে গরম আর গরমের দিনে ঠান্ডা থাকে বলে অনেকে মাটির বাড়িটির নাম দিয়েছেন গরিবের এসি ঘর। বিশাল এই বাড়িতে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৪০ জন থাকেন।

পুরো বাড়ি কিন্তু একবারে গড়ে ওঠেনি। প্রায় ১০০ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল বাড়িটির মূল অংশ। ১৯৮৬ সালে এই বাড়িরই দুই আখন্দ ভাই সমশের আলী ও তাহের আলী এবং তাঁদের একমাত্র বোন মাজেদা মণ্ডল পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে বাড়িটি পরিবর্ধনের কাজে হাত দেন।

বাড়িটিতে অনেকগুলো পরিবার মিলেমিশে আছেন ৪০ বছর ধরে

কাছের একটা টিলা থেকে গরুর গাড়িতে করে মাটি আনা হতো। বাড়ির পাশের পুকুর থেকেও মাটি তোলা হতো। সংগৃহীত মাটির সঙ্গে খড় মিশিয়ে তৈরি হতো দেয়াল তৈরির মণ্ড। সেই মণ্ড দিয়ে প্রায় এক হাত পরিমাণ দেয়াল তুলে অপেক্ষা করতে হতো মাটি শুকিয়ে আসা পর্যন্ত। শুকিয়ে এলে চলত নতুন মণ্ড বসিয়ে দেয়ালের পরবর্তী ধাপের কাজ। এভাবে প্রায় ৯ মাস ধরে বিভিন্ন গ্রামের ৮০ জন কারিগর পুরো ঘর নির্মাণ করেন। ৩০০ ফুট বাই ১০০ ফুট বাড়িটির দেয়াল নিচের দিকে ৩০ ইঞ্চি আর ওপর দিকে ১৫-২০ ইঞ্চি পুরু।

ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ২০০ বান্ডিল টিন! এই টিন কেনা নিয়েও গল্প আছে। শোনালেন তাহের আলী আখন্দের নাতি নাজমুছ ছাকিব। তিনি জানান, সদ্য মাটির কাজ করে একদিন ২০০ বান টিনের অর্ডার করতে যান দুই ভাই তাহের ও শমশের। তাঁদের পোশাকে কাদামাটি দেখে দোকানির কাছে অর্ডারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি! পরে বাধ্য হয়ে পোশাক পরিবর্তন করে টাকার থলি (বলা চলে টাকার বস্তা) নিয়ে দোকানির সামনে ফেলেন তাঁরা। এ যাত্রায় বিশ্বাস তো হয়ই, একসঙ্গে এত টিন নেওয়ায় একটি ফনিক্স ব্যান্ডের সাইকেলও উপহার দেন দোকানি।

বাড়িটি যেমন

বাড়ির কিছু কিছু অংশে দীর্ঘদিন প্রলেপ দেওয়া হয়নি

পায়ে হেঁটে পুরো বাড়ি চক্কর দিতে কয়েক মিনিট লাগলেও ভিতর–বাহির খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় রাখতে হবে। নিচতলা ও দোতলায় পাশাপাশি দুই সারি কক্ষ ও বারান্দা। বৃষ্টির পানিতে যাতে মাটি কেটে না যায়, তার জন্য বাইরের দেয়ালে আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া আছে।

নিচতলার বারান্দার ওপরের অংশে এবং দোতলার বারান্দার নিচের অংশে নানা কারুকাজ। বাইরের বারান্দার কোনো অংশে বৈঠকখানা, কোনো অংশে গবাদিপশুর খোঁয়াড় আবার কোথাও গৃহস্থালি অনুষঙ্গ ও জ্বালানিসামগ্রী রাখা।

১০৮ কক্ষের এই বিশাল বাড়িতে মূল প্রবেশদরজা আছে ৭টি। আবার প্রতিটি ঘরে আলাদা করে রয়েছে একাধিক দরজা। একসময় যেকোনো একটি দরজা দিয়ে ঢুকে একে একে ১০৮ কক্ষেই যাওয়া যেত। পরিবার ভাগ হয়ে যাওয়ায় কিছু কিছু প্রবেশমুখে এখন দেয়াল উঠেছে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৮টি। সিঁড়ি কিছুদূর উঠেই ভাগ হয়ে দুই দিকে উঠে গেছে। সিঁড়ির একটি অংশ থাকার ঘরে, অন্য অংশ জানালাহীন ছোট্ট একটি বন্ধ ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। এটি মূলত ধান রাখার জন্য শস্যভান্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখনো শস্য রাখার মটকা, লাঙল, জোয়াল, দা, কোদাল, কাস্তে, শাবল, পানি দেওয়ার সেঁউতিসহ বিভিন্ন কৃষিজ যন্ত্রপাতি রাখা আছে। ১০৮টি কক্ষের মধ্যে এমন ছোট্ট ঘর আছে ১২টি। বাকি ৯৬টিই বড়, থাকার জন্য।

বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া পুকুর

তেমনই কয়েকটি ঘর আমাদের ঘুরে দেখালেন বাড়ির এক মালিক তাহের আখন্দের স্ত্রী হালিমা বেগম। প্রায় প্রতিটি ঘরেই বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা রয়েছে। ঘরের মেঝে ও সিঁড়িতে লাল মাটির প্রলেপ, প্রথম দেখায় মনে হবে যেন কৃত্রিম রং! মেঝে ও সিঁড়িতে আবার নকশিকাঁথার আদলে হালিমা বেগমের নিজ হাতে বোনা মাদুর পাতা। দোতলার মেঝে ও ছাদ তালগাছের পাটাতন ও বাঁশের ফালির ওপর মাটি দিয়ে তৈরি। বাড়িটি মাটির হলেও কয়েকটি অংশে এখন ইটের গাঁথুনিতে টয়লেট ও গোসলখানাও চোখে পড়ে।

কিছু অংশে এখন শুধু কাঠ, জ্বালানি রাখা হয়

বাড়ির মাঝে তিনটি উঠান। উঠান ঘেঁষে রান্নাঘর, সেখানে মাটির চুলায় চলে রান্নাবান্না, ধোঁয়াটা পাইপে করে বাইরে চলে যায়। উঠানে ডালিম, পেয়ারা আর নারকেলের গাছও আছে। নিচে হাঁস–মুরগির ছোটাছুটি থাকলেও টিনের চালটা কবুতরের দখলে থাকে। বাড়ির সঙ্গেই একটি বড় পুকুর। সেখানে বাসিন্দাদের কেউ কেউ বসে খোশগল্পে মেতেছেন। কেউ গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

  দর্শনার্থীর আনাগোনা

মাটির ঘরে কাঠের দরজা

গাইবান্ধা থেকে এসেছে একটি পরিবার, ফেসবুকে বাড়িটা দেখে এখন স্বচক্ষে দেখতে এসেছে। প্রতিদিনই এ রকম দর্শনার্থীদের আনাগোনা থাকে। বাড়ির বাসিন্দাদেরও এটা গা সওয়া হয়ে গেছে। আমি যেমন ঢাকা থেকে এসেছি আর জয়পুরহাট থেকে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন দুই আলোকচিত্রী সোহেল রানা ও আশিক হোসেন। এই প্রতিবেদনের জন্য ড্রোন উড়িয়ে ওপর থেকে ছবি তোলেন তাঁরা। এমন করেই দর্শনার্থী আসেন, দেখে মুগ্ধতায় ভাসেন। কেউ আবার কবিতাও লিখে ফেলেন। ‘মাটির প্রাসাদ’ নামে যেমনটা লিখেছেন শফিক শাহরিয়ার—

ইট পাথরের প্রাসাদ দেখেছ দেখেছ কী সুন্দর!

আলীপুর গ্রামে মাটির প্রাসাদ এক শ আটটি ঘর।

এই ঘরখানি নাও দেখে নাও

একবার এসে যাও দেখে যাও—

এই বাড়িটির চারপাশে দেখো সবুজের বন্দর।

লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বসত (মে ২০২৪) ম্যাগাজিনে প্রকাশিত