জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ছাত্রনেতা তালেব উদ্দিন আহমদ। পরে নির্মম নির্যাতন করে প্রকাশ্যে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে তারা। এখনো তাঁর সাহসিকতার কাহিনি গর্ব ভরে স্মরণ করে সুনামগঞ্জবাসী। ছোট ভাই শামসুল ইসলামের কাছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের গল্প শুনেছেন সুমনকুমার দাশ
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল তিন বছর। তালেব ভাইয়ের একটা স্মৃতিই শুধু আমার আবছা মনে আছে। একদিন রাতে রণাঙ্গন থেকে হঠাৎ বাড়ি ফিরেছেন। মাইজিকে নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা তাঁকে ঘিরে আছি। খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই মেঝেতে শুয়ে পড়ি। ভাই কী কী যেন গল্প করে যাচ্ছিলেন। আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।
তবে বড় হতে হতে মাইজি আর আব্বার কাছ থেকে জেনেছি শহীদ তালেবের স্মৃতি আর যুদ্ধদিনের নানা কথা। ভাইয়ের সহযোদ্ধারাও কোথাও কোথাও লিখেছেন।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার হাতিয়া গ্রামে আমাদের বাড়ি। সাত ভাই চার বোনের মধ্যে তালেব উদ্দিন আহমদ ছিলেন সবার বড়। স্থানীয় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে সুনামগঞ্জ কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এ কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। ছিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রনেতা হওয়ায় শহরে তো বটেই, মহকুমাজুড়েই বড় ভাইয়ের পরিচিতি ছিল।
যখন যুদ্ধের দামামা বাজে, তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ছাত্র-যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে একাধিক সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়ও পান।
তোমরা সরে যাও, আমি দেখছি
সেদিন ছিল ২৭ নভেম্বর। সুনামগঞ্জ সদরের ইসলামপুর-চিনাউড়ার মাঝামাঝি একটা জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন ভাইয়ের নেতৃত্বে তাঁর সহযোদ্ধারা। একপর্যায়ে ভাইদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। তিন দিকে পাকিস্তানি সেনা, এক দিকে পানি। মাঝখানে আটকা পড়েন তাঁরা। উপায়ান্তর না দেখে সহযোদ্ধাদের পালিয়ে যেতে বলে নিজে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন তালেব ভাই। কিন্তু তাঁকে ফেলে অন্যরা যেতে নারাজ। তখন তিনি বুঝিয়ে বললেন, একসঙ্গে পিছু হটলে পাকিস্তানিরা সবাইকে শেষ করে ফেলবে। তাঁকে যেহেতু রাজাকার আর পাকিস্তানিরা চেনে, আত্মসমর্পণ করলে অন্যদের সরে পড়তে সুবিধা হবে।
একসময় রাজি হয়ে পাশের খরস্রোতা ধলাই নদ দিয়ে চলে যান সহযোদ্ধারা। বড় ভাই হাত ওপরে উঠিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সামনে দাঁড়িয়ে যান। অসীম সাহসী এই যোদ্ধাকে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা সহজেই চিনে ফেলে। ওদিকে সরে পড়েন সহযোদ্ধারা।
বড় ভাইকে আটক করে চোখ বেঁধে পাকিস্তানি সেনারা সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে আসে। শহরের পিটিআই স্কুলে তাঁর ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। যেহেতু তিনি সুপরিচিত ছাত্রনেতা ছিলেন, তাই তাঁকে নির্মমভাবে মারধর ও অপমান করে শহরবাসীর মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার-দালালেরা। ভাইয়ের গলায় জুতার মালা পরিয়ে পিকআপে বেঁধে পুরো শহর ঘোরানো হয়। সুনামগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের সামনে তাঁকে বেঁধে রেখে চড়থাপ্পড় মেরে আর জুতাপেটা করে অপমান করা হয়।
‘জয় বাংলা’ স্লোগান ভালো দিতেন বলে তালেব ভাইয়ের আরেক নাম ছিল ‘জয় বাংলা তালেব’। রাজাকাররাও এ তথ্য জানত। তাই ভাইকে দিয়ে তারা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তালেব ভাই প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের সামনেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। এরপর তাঁর ওপর চলে আরও ভয়াবহ নির্যাতন। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হয় তাঁর শরীর। টানা ১০ দিন ধরে চলে পৈশাচিক অত্যাচার।
ভাইকে আটকের কিছুদিন পর থেকেই যুদ্ধ পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ৬ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা সুনামগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। ফেরার সময় তারা ভাইকেও বেঁধে নিয়ে যায়। পথে (শান্তিগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত) আসানমারা ফেরিঘাট এলাকায় ভাইসহ তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাষণ্ডরা।
টানা কয়েক দিন ভাইয়ের লাশ পানিতে ভেসে ছিল। তাঁদের মরদেহ শনাক্তের পর পাশের জয়কলস উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে সমাহিত করে।
সেদিন ছিল ১৩ ডিসেম্বর।