একজনের রোল নম্বর 20ESD039, আরেকজনের 20ESD040। শুধু রোল নম্বরই নয়, মনের দিক থেকেও খুব কাছাকাছি ছিলেন দুজন। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরপ্রবি) এই দুই শিক্ষার্থী অল্প কদিনেই হয়ে উঠেছিলেন প্রাণের বন্ধু। নয়তো বন্ধুকে বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস কজনই-বা দেখায়!
পরিবেশবিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন মোবাশ্বেরা তানজুম (হিয়া) ও তাসপিয়া জাহান (ঋতু)। সহপাঠী থেকে দ্রুতই তাঁরা বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। একসঙ্গে থাকা কিংবা ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি যাওয়া। ক্লাসে একই বেঞ্চে বসা। সব একসঙ্গে করা চাই। বিভাগের কোনো আয়োজন কিংবা বন্ধুদের কারও জন্মদিন—সবকিছুতে থাকত তাঁদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি।
আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো তানজুম আর তাসপিয়াকেও ভীষণ মুগ্ধ করত ক্যাম্পাসের বৃষ্টি। কে জানত, সেই বৃষ্টি উপভোগ করতে গিয়েই এমন নির্মম পরিণতি হবে। সোমবারও (৩১ জুলাই) একসঙ্গে তাঁরা বৃষ্টিতে ভিজেছেন। বন্ধু জাকারিয়া আসিফকে বলে রেখেছিলেন, এরপর কখনো বৃষ্টি হলে সবাই একসঙ্গে ভিজবেন। ঘটনাক্রমে পরদিন দুপুরেই শুরু হলো বৃষ্টি। কিন্তু আসিফ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় এসেছিলেন দেরি করে। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। লেকের পাড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান তানজুম। তাঁকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাসপিয়া। কিন্তু কেউ কাউকে বাঁচাতে পারেননি। প্রাণ হারান দুজনই।
বন্ধুদের কথা স্মরণ করতে গিয়ে জাকারিয়া আসিফের কণ্ঠে এখন আক্ষেপের সুর। মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘এই আফসোস আমার সারা জীবন থাকবে। হয়তো ওদের সঙ্গে তখনই গেলে এমন দুর্ঘটনা না-ও হতে পারত।’
দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও ক্লাসে রুবাইয়া খাতুনের সঙ্গে তানজুম-তাসপিয়ার কথা হয়েছে। রুবাইয়াকেও বৃষ্টিতে ভেজার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দুজন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুবাইয়ার আর যাওয়া হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসে দুঃসংবাদ। শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তিনি।
রুবাইয়া বলেন, ‘ওদের মৃত্যুসংবাদ আমার কাছে এখনো একটা দুঃস্বপ্নের মতো। কারণ, কয়েক মিনিট আগে ক্লাসে যাদের সঙ্গে কথা বললাম, হাসি-তামাশা করলাম, যারা “চল, একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজব” বলতে বলতে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, তারা কীভাবে মারা যেতে পারে! যখন ওদের ফ্যাকাশে চেহারা আর নিথর দেহের সামনে গেলাম, তখনো আমার মনে হচ্ছিল না হিয়া আর ঋতু বেঁচে নেই। বারবার এই আশায় ছিলাম যে এইতো ওরা একটু পর সুস্থ হয়ে যাবে। মনে হচ্ছিল হয়তো কোনো ভুল হচ্ছে। কিন্তু ওরা তো আর আসবে না।’
দুই শিক্ষার্থীকে স্মরণ করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ ও সহপাঠীরা। লেকপাড়ে দুর্ঘটনাস্থলে তাঁদের নামে একটা স্মারক তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের নামে বিভাগে একটি স্মারক, সেমিনার রুম, শিক্ষাবৃত্তি চালু ইত্যাদি প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে।
তানজুম ও তাসপিয়ার বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে জাকারিয়া আসিফের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে আমাদের ক্যাম্পাসটা ছোট। এখানে প্রতি পাঁচজনের চারজনই হয়তো হিয়া ও ঋতুকে চিনবে। সেটা তাদের বন্ধুত্বের কারণেই। সব সময় একসঙ্গে থাকত। এখন একজনের জন্য আরেকজনের ত্যাগের কথা দেশবাসীও জানতে পারল। ওরা দুজনই মানুষ হিসেবে ভীষণ ভালো। একটা কাজ দুবার না ভেবে করে ফেলত। খুবই সরল মনের ছিল। ওদের হারিয়ে আমরা অনেকটা দিশাহারা হয়ে গেছি।’
তানজুম ও তাসপিয়ার ঘুরে বেড়ানোর শখ ছিল। সেসব পরিকল্পনার অংশ ছিলেন রুবাইয়া খাতুনও। এই সপ্তাহেই যেমন তাঁদের একসঙ্গে রান্না করে খাওয়ার কথা ছিল। পরিকল্পনা করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে পদ্মবিলে ঘুরতে যাবেন। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই আর বাস্তবে রূপ নেবে না। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা ঘুরতে যাবেন ঠিকই, কিন্তু থাকবে না তানজুম ও তাসপিয়া। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রুবাইয়া। বলেন, ‘পদ্মবিলে এখনো ফুল ফোটেনি। ফুটলেই আমাদের যাওয়ার কথা। কিন্তু এর মধ্যে কী হয়ে গেল! ক্যাম্পাসে আমরা একটা দোকানে বসে ঝালমুড়ি, ফুচকা, চটপটি, চা খেতাম। আড্ডা দিতাম। হাসাহাসি করতাম। দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে সেই দোকানে গিয়ে আমি আর শান্তি পাচ্ছি না। খালি মনে হচ্ছে, হিয়া ও ঋতু কখন আসবে!’