১ ক্যাম্পাসের ৩ দ্রুততম দৌড়বিদ

শিরিন আক্তার, সাইদুর রহমান ও সুফিয়া খাতুন
ছবি: কোলাজ

বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত যতজন দ্রুততম মানব ও মানবী পেয়েছে, তাঁদের মধ্যে তিনজনই পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে—সুফিয়া খাতুন, সাইদুর রহমান ও শিরিন আক্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্রটা কেমন? বর্তমান শিক্ষার্থীরাই–বা এই কীর্তিমানদের নিয়ে কী বলছেন?

জন্ম পশ্চিমবঙ্গে হলেও পারিবারিক কারণে ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে চলে আসেন সুফিয়া খাতুন। ১৯৭৪ সালের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে দ্রুততম মানবী খেতাব পান তিনি। উচ্চমাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে আন্তহল ও আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জিতেছেন নানা পদক। এসব প্রতিযোগিতায় তো বটেই, ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত টানা পাঁচবার হয়েছেন বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া প্রশিক্ষকের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।

বর্তমানে মুর্শিদাবাদে মেয়ের কাছে আছেন সুফিয়া। সেখান থেকে ফোনেই শোনালেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের নানা কথা। গল্পে গল্পে স্মরণ করলেন ১৯৭৭ সালে একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার স্মৃতি, যেখানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

সুফিয়া খাতুন

ময়মনসিংহ জেলা স্টেডিয়ামে আয়োজিত সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেও আয়োজক কর্মকর্তাদের চাপে তাঁকে দ্বিতীয় করা হয়। সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘এই ঘটনা নিয়ে তখন স্টেডিয়ামে অনেক উত্তেজনা হয়েছিল। দর্শকেরাও মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু আমি বলেছি, রেফারি যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই মেনে নেব। পরে সাংবাদিকেরা আমাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করে, আমি তখন বলেছি পরবর্তী টুর্নামেন্টে (বাংলাদেশ গেমস) যদি ৫ মিটার বেশি ব্যবধানে জিততে না পারি, তাহলে আমি সবার পেছনেই থাকব। যেন এই ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হয়। সেই টুর্নামেন্টে আমিই দ্রুততম মানবী হই। এরপর টানা পাঁচবার আমি এই খেতাব পাই।’

সাইদুর রহমান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমানও সুফিয়া খাতুনেরই সমসাময়িক। ১৯৮২–৮৪ পর্যন্ত দেশের দ্রুততম মানব ছিলেন এই অ্যাথলেট। তবে তাঁর নামটি বেশি সামনে আসে বাংলাদেশের প্রথম অলিম্পিয়ান হিসেবে। ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে অংশ নেন তিনি। ১৯৮৪ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে প্রথম সাফ গেমসে ৪x১০০ মিটার রিলেতে সোনাজয়ী বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন সাইদুর রহমান, ডন নামেই যাকে লোকে চেনে বেশি। তাঁর সঙ্গে আমরা অবশ্য যোগাযোগ করতে পারিনি।

তবে সুফিয়া খাতুন জানালেন, একই সময়ে দেশের দ্রুততম মানব-মানবী দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। বলছিলেন, ‘আমরা দুজনই আমার স্বামীর অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। একসঙ্গে অনেক স্মৃতি আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামে আমরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদের তৈরি করতাম। তিনি অলিম্পিক গেমসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আমি সেটা না পারলেও বাছাই অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। একই ক্যাম্পাস থেকে এই অর্জন অবশ্যই অনেক ভালো লাগার।’

দ্রুততম মানবী শিরিন

সাইদুর রহমানের অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার অনেক লম্বা সময় পর তাঁর উত্তরসূরি খুঁজে পায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ৩২ বছর পর ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে অংশ নেন দেশের বর্তমান দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে পড়েছেন এই দৌড়বিদ। দেশের দ্রুততম মানবীর খেতাব পেয়েছেন ১৫ বার। সর্বশেষ এ বছর ৪৭তম জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতাতেও ১২.১১ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করেন দ্রুততম মানবী শিরিন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বেশ কিছু পদক পেয়েছেন শিরিন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে এসব পদক এনে দিতে পেরে তিনি দারুণ গর্বিত। মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ২০১৪-১৫ সেশনে। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় গেমসে চ্যাম্পিয়ন ও ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বিশ্ব ইউনিভার্সিটি গেমস খেলারও সুযোগ পেয়েছি ইতালির নাপোলিতে। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশ বা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারা আমার জন্য অনেক গর্বের ও আনন্দের।’ এসব অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার সহযোগিতা পেয়েছেন, সে কথাও বললেন শিরিন।

তাঁদের ক্যাম্পাস থেকেই দেশের তিন দ্রুততম মানব-মানবী উঠে এসেছেন, ব্যাপারটা বর্তমান শিক্ষার্থীদেরও গর্বিত করে। কথা হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান দ্রুততম মানব সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী শামিউল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ক্রীড়া ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা একটা অবস্থান আছে। বাংলাদেশের তিন দ্রুততম মানব–মানবী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের, এটা একজন দৌড়বিদ হিসেবে আমাকেও অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে ভালো করতে খেলোয়াড়দের আরও সুযোগ করে দিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা দরকার। আমাদের এখানে খেলাধুলার পরিবেশ বেশ ভালো। জিম বা অন্যান্য সুযোগের পাশাপাশি এখন উপবৃত্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছে।’

কিছুটা আক্ষেপের কথা বললেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শারীরিক শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক পার্থপ্রতিম মল্লিক। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্রীড়া ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা আলাদা সুনাম ছিল। কিন্তু দিন দিন সেটা কমে যাচ্ছে। ভর্তিপ্রক্রিয়ার নানা জটিলতার কারণে আমরা যোগ্য অ্যাথলেটদের নিতে পারছি না। এই প্রক্রিয়া সহজ করলে হয়তো আমরা ভালো ভালো অ্যাথলেট পাব, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করবেন।’